Bangla Romantic Love Stories – Part – 2 | রোমান্টিক প্রেম

WhatsApp Channel Follow Now
Telegram Group Follow Now

Last updated on July 4th, 2023 at 12:50 am

আজকের Bangla Romantic Love Stories টির নাম – “নেকী” গল্পের প্রধান চরিত্রে অশোক ও লীলা, বিষয় – রোমান্টিক ভালোবাসা, Sad Love Story in Bengali এবং Valobashar golpo অথবা Bengali Funny Jokes আরও পাওয়ার জন্য আমাদের ব্লগ টিকে সাবস্ক্রাইব করে আমাদের সাথে থাকুন, গল্পটি পড়িয়া যদি আপনার ভালো লাগিয়া থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট এবং শেয়ার করিতে ভুলিবেন না।

Bangla love stories

Romantic Love Stories in Bangla – রোমান্টিক ভালোবাসার গল্প

আজকের গল্প – নেকী
পর্ব – দ্বিতীয়


বড়লােকের মেয়ে, কলকাতায় বাবার ব্যবসা ছিল। মা কবে মারা গিয়েছিলেন নেকীর মনে নেই। পিসীমাই তাকে মানুষ করেছে। কি সব কারণ ঘটেছিল নেকী জানে না, তার যখন ষােল বছর বয়স, ব্যবসা ভেঙ্গে পড়ল। বাজারে দেউলিয়া নাম জাহির করার আগেই বন্দুকের গুলিতে নিজের মাথাটা ফুটো করে দিয়ে নেকীর বাবা সব দায় এড়িয়ে গেলেন। আপনার বলতে এই মামা, চোখ মুছতে মুছতে বছর দুই আগে পিসীকে নিয়ে এই মামার আশ্রয়ে এল। পিছনে ফেলে এল আজন্ম-অভ্যস্ত সৌখীন জীবন। 




নতুন জীবনের ভয় বাবার শােককে পর্যন্ত ছাপিয়ে উঠেছিল অশােকবাবু। পাড়া গাঁ চক্ষে দেখিনি, পিসীর কাছে শুনে দুচোখে খালি অন্ধকার দেখতে লাগলাম। গাঁয়ের মেয়েরা কি ভাবে থাকে, ভাের পাঁচটায় উঠে কেমন করে গােবর দিয়ে ঘর নিকোয়, ডােবায় গিয়ে বাসন মাজে, লাউ কুমড়াের চচ্চড়ি দিয়ে কেমন আরামে দু বেলা পেট ভরায়, পিসীর কাছে লম্বা ফিরিস্তি শুনে মনে হয়েছিল কাজ নেই বাবা বেঁচে থেকে, তার চেয়ে আপিঙ গুলে খাওয়া সহজ। অশােক বললে, তারপর যখন সত্যি সত্যি এলে তখন কেমন লাগল। 

নেকী বললে, এসে দেখলাম ভয়ের কারণ নেই, ঘর নিকোবার দরকার হল না, বাসনও মাজতে হল না। রান্নার ভারটাও পিসীমা নিলেন। সেদিক থেকে বিশেষ কষ্ট হল না, কিন্তু কপাল মন্দ, আমি আসার তিন মাসের ভিতরেই কয়েকটা মােকদ্দমায় হেরে মামার অবস্থা ভয়ানক খারাপ হয়ে গেল। মামা অবশ্য বললেন না, অবস্থা বুঝে আমি নিজেই ঝিকে ছাড়িয়ে দিলাম। বুক বেঁধে একদিন যে ভয়ে আপিঙ খেতে ইচ্ছে হয়েছিল সেই গােবর লেপা থেকে শুরু করে বাসন মাজা পর্যন্ত সব কাজগুলি করে ফেললাম। কোথাও কিন্তু বাধল না। অশােক বললে, রান্নাটাও বােধহয় এখন করতে হয়?

হ্যা। পিসীমার বাতের শরীর, পারেন না।
ঝড়ের বেগ কম পড়তেই নেকী বলল, আপনি এখন আসুন অশােকবাবু। একা ফেলে গেছে, পিসী হয়ত ঝড় ঠেলেই এসে পড়বে। এ সামান্য ঝড়ে আর গাছ পড়বে না।
অশােক উঠে দাঁড়িয়ে বলে, পিসীর আসার কথাই ভাবছ, আমি যদি সবাইকে বলে দিই সন্ধেটা কোথায় কাটিয়ে গেলাম?
নেকী হেসে বললে, ওইটুকু আপনি করতে পারেন না, এই দু-ঘণ্টার কথা সম্পূর্ণ গােপন থাকবে।
মাকে কিন্তু বলতে হবে।
তা তাে হবেই, মাসীমাকে বলবেন বৈকি! আমি অন্য লােকের কথা বলছিলাম। চলুন আপনাকে বরং একটু এগিয়ে দিয়ে আসি।

অশােক হেসে বললে, তারপর তােমাকে কে এগিয়ে দিয়ে যাবে লীলা?
আমার দরকার হবে না, একাই আসতে পারবাে।
অশােক ঘরের বাইরে পা দিয়ে বলল, বাড়াবাড়ি কোরাে না, আমি শিশু নই। দরজা দিয়ে বােস, এটুকু খুব যেতে পারবাে।
আচ্ছা, আসুন তবে।
অশােক বারান্দার সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাবে, নেকী বলল, বাড়ি গিয়েই কাপড় ছেড়ে ফেলবেন কিন্তু। দুবার ভিজতে হল, অসুখ না হয়।
আচ্ছা, বলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়ে আবার উঠে এল। বললে, তােমার ভয় করবে না তাে?




একটু একটু করবে। আর দাঁড়াবেন না, পিসী এলে ভারী মুশকিলে ফেলবে। অশােক উঠানে নেমে গেল। নেকী চেঁচিয়ে বলল, আর একটা কথা অশােকবাবু, আপনাতে আমাতে সন্ধি তাে?
উঠান থেকেই ঘাড় ফিরিয়ে অশােক বললে, সন্ধিপত্রের খসড়া তৈরি করে রেখাে সই করে দেব। বলে রান্না ঘরের ওদিকে অদৃশ্য হয়ে গেল। নেকী সেখানে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। ঝড়ের বেগ কমেছিল, কিন্তু বৃষ্টি সমভাবেই পড়ছিল। ছাট লেগে নেকীর বসনপ্রান্ত ভিজে যেতে লাগল, কিন্তু সেদিকে তার খেয়ালই রইল না। পরদিন সকালে অশােকের জামা আর কাপড় হাতে করে যেতেই অশােকের মা নেকীকে জড়িয়ে ধরে চুমমা খেলেন। 

বললেন, বাগানের এক একটা গাছ পড়ার শব্দ শুনছিলাম আর আমার বুকের পাঁজর যেন ভেঙে যাচ্ছিল মা। যে ছেলে, তুই না ডাকলে ওই বাগানের ভেতর দিয়েই আসত। সুখে তৃপ্তিতে লজ্জায় নেকীর মুখখানা আরক্ত হয়ে উঠল। মাথা নত করল। মা বললেন, বােস, খাবার খেয়ে যাবি। ঠাকুরকে ভাড়ারটা বার করে দিয়ে আসি। বলে চলে গেলেন। আপনার জামার পকেটে এই কাগজপত্রগুলি ছিল অশােকবাবু। ভিজে চুপসে গেছে। অশােক কাগজগুলি নিয়ে বলল, মানিব্যাগটা?
মানিব্যাগ? মানিব্যাগ তাে ছিল না!
ছিল না কি রকম? কাগজ রইল, মানিব্যাগ উড়ে গেল?

নেকী হেসে ফেললে, যতই করুন অশােকবাবু, আর ঝগড়া বাধবে না। সন্ধি হয়ে গেছে। ঠাট্টা নয়, বেশি টাকা ছিল নাকি?
না, গােটা পাঁচেক ছিল। দৌড়বার সময় মাঠে পড়েছিল বুঝেছিলাম, তুলে নেবার সময় হয়নি। ভালােই হয়েছে, সারের কাজ দেবে।
তা দেবে, টাকার মতাে সার আর নেই।
মাস খানেক কেটে গেছে।
সকাল বেলায় মা চা করছিলেন, ঝড়া ফুলের মতাে, পরিম্লান মূর্তি নিয়ে নেকী এসে তার গা ঘেঁষে বসে পড়ল।
মা বললেন, জ্বর ছেড়েছে উঠে এলে যে?
জ্বর নেই। আমায় এককাপ চা দিও মাসিমা।
এখনাে খাসনি কিছু?
নেকী ঘাড় নাড়ল।

তবে আগে একটু দুধ খেয়ে নে, তারপর চা খাস। দুদিনের জ্বরে কি চেহারাই হয়েছে মেয়ের!
স্টোভের ওপর কড়ায় দুধ জ্বাল হচ্ছিল, বাটিতে ঢেলে নেকীর সামনে ধরলেন। অশােক বললে, তিন চার বার করে পচা ডােবায় স্নান করলে জ্বর হবে না। নেকী বললে, প্রথমদিন থেকেই ও পুকুরে স্নান করাটা আপনার চক্ষুশূল হয়েছে। দেখছি। -কি মুশকিল! এ মেয়েটা প্রথম দিনের সেই ঘটনাটুকু নিজেও ভুলবে না, অশােককেও ভুলতে দেবে না।




আরও পড়ুনঃ গল্পঃ জল পরী 

মা কি কাজে উঠে যেতেই বাটির দুধ প্রায় সবটা কড়ায় ঢেলে দিয়ে চোখ কান বুজে বাকিটুকু নেকী উদরস্থ করে ফেললে। চায়ের কাপ তুলে নিয়ে বললে, দুধ তাে না বিষ!
তাই তাে দেখছি, মাকে বলতে হবে।
না লক্ষ্মী, বলবেন না। এক্ষুনি একবাটি দুধ গিলিয়ে দেবেন।  ভালােই তাে।
ভালাে বৈকি! চায়ের কাপটা শেষ করে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে, মা আসবার আগেই পালাই তাহলে।
অশােক বলল, না, বােস বলব না।
রাঁধতে হবে, পিসীমার অসুখ।
এই শরীরে রাঁধবে?

না রাঁধলে চলবে কেন? মামা দু দিন হাত পুড়িয়ে রেধে খেয়েছেন। ঐ যা, আসল কথাই ভুলে গেছি। বিকালে আপনার আম খাবার নেমন্তন্ন রইল, পুলককে নিয়ে যাবেন। বলে নেকী চলে গেল। বিকালে প্রায় ছটার সময় পুলককে সঙ্গে নিয়ে অশােক আম খাবার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেল। হৃদয় চক্রবর্তী একগাল হেসে অভ্যর্থনা করলেন। কি সৌভাগ্য কথাটাই উচ্চারণ করলে বার কুড়ি। চক্রবর্তীর বয়স নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। মাথার চুলে পাক ধরেছে। চুল বলা সংগত নয়, কদম ফুলের পাপড়ি। মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল। হাসবার উপক্রম করলেই সেই জঙ্গল ফাক হয়ে তামাকের ধোঁয়ায় বিবর্ণ কতগুলি দাঁত আত্মপ্রকাশ করে এমনি অতিরিক্ত বিনয় প্রকাশ করতে লাগলেন যে, সেগুলি প্রকাশ হয়েই রইল। বড় ঘরের বারান্দায় সেই ভাঙা চেয়ার আর টুলখানা পাতা হয়েছিল, অশােক আর পুলককে বসিয়ে চক্রবর্তী নিজে একটা পিড়ি দখল করে উবু হয়ে বসে ডাকলেন, নেকী!
নেকী ভেতর থেকে সাড়া দিল, আম কেটে নিয়ে যাচ্ছি মামা। দু’থালা বােঝাই আম দুজনের সামনে ধরে দিতেই অশােক বললে, একি ব্যাপার!

এত আম খাব কি করে?
চক্রবর্তী মাথা নেড়ে বললেন, কিছু না কিছু না। যুবাকাল, লােহা পেটে পড়লে হজম হয়ে যাবে। খান, লজ্জা করবেন না। আপনার মাঠাকরুন নেকীকে স্নেহ করেন তাই, নইলে আমাদের মতাে লােকের বাড়ি আপনাকে খেতে বলা সাহসই হত না। নেকী মুচকী হেসে ভেতরে চলে গেল। কি যে বলেন, বলে অশােক একটা আম মুখে তুলে নিল। বলল, খা পুলক, উনি যখন ছাড়বেন না, যা পারি খাই, বাকি নষ্ট হবে।
চক্রবর্তী মােক্তার মানুষ, বকতে পারেন, আসর সরগরম করে রাখলেন। অশােক কখনাে হুঁ দিয়ে কাজ সারতে লাগলাে, কখনাে বললে, নিশ্চয়! কখনাে মৃদু হেসে বললে, তা-বই কি। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ভ্রমণ করে চক্রবর্তী কলিকালের লােকদের ধর্মজ্ঞানহীনতা এবং উৎকট লােভ পরায়ণতার কথা কীর্তন করলেন। বললেন, আদালতে অত মামলা মােকদ্দমা কি জন্য মশায়? ওই লােভ। কেন রে বাপু পরের জিনিস নিয়ে টানাটানি কেন? নিজের যা আছে তাই নিয়ে নেড়েচেড়ে খা না। 

অশােক ঘাড় নেড়ে সায় দিলে, তা বৈ কি। এইবার চক্রবর্তী এই চিন্তার উৎসমুখের সন্ধান পাওয়া গেল। একটা পাজি লােক তার পাঁচ বিঘে জমি যে কি রকম ভাবে আত্মসাৎ করার উপক্রম করেছে এবং অশােকের বাবার কাছেই মিথ্যে দাবীর মােকদ্দমা রুজু করেছে তার সবিস্তার বর্ণনা করে চক্রবর্তী ফেঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। শুনে অশােক আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করলে। থালা অর্ধেক খালি করে ঠেলে দিতেই চক্রবর্তী হাত জোড় করলেন, অশােক ব্যস্ত হয়ে বললেন, ওকি! ওকি! সত্যি বলছি আর খাবার ক্ষমতা নেই, নইলে ফেলে রাখতাম না। লােকটার প্রতি অশ্রদ্ধায় অশােকের অন্তর পূর্ণ হয়ে গেল। বাপের বয়সী ভদ্রলােক, বিনয়ের ছলে ক্রমাগত নিজেকে হীন করে ফেলছেন দেখে অত্যন্ত বেদনা অনুভব করল। জোড় হাতেই চক্রবর্তী নিবেদন করলেন, তবে দুটি সন্দেশ মুখে দিন। 




বলে হঠাৎ ক্রুদ্ধ হয়ে হাঁকলেন, নেকী! নেকী!
নেকী নিঃশব্দে চৌকাঠের সামনে এসে দাঁড়াল।
দুটো আম ফেলে দিলেই হবে? একি হেঁজি পেঁজি লােক পেয়েছিস। বাপের তাে টাকা ছিল, এটুকু শিক্ষাও হয়নি? সন্দেশগুলাে কি তাের জন্য এনেছি নেকি?
চারটে প্রশ্ন! নেকী নত মুখে শুধু সন্দেশের সংবাদটাই দিল, সন্দেশ নাই!
নেই? কি হলাে? পাখা গজিয়েছে?
আছে, দেওয়া যাবে না। হাঁড়ি ভেঙে সন্দেশ মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। হাঁড়ি ভাঙল কেন?
তাকের ওপর ছিল, বেড়ালে ফেলে দিয়েছে।
ই, বলে চক্রবর্তী স্তব্ধ হয়ে গেলেন।

অশােক হেসে বললে, বেড়াল ভালাে কাজ করেছে, এর ওপর সন্দেশ খেলে ডাক্তার ডাকতে হত।
চক্রবর্তী সখেদে বললেন, ষোল সতের বছর বয়স হল, কোনােদিকে যদি নজর থাকে! আপনার জন্য কত যত্ন করে আনা। হায়! হায়! আগেই জানি অদৃষ্ট আমার নিতান্তই মন্দ!
অশােকের ভাগ্যে সন্দেশ জুটল না, সে জন্য চক্রবর্তীর অদৃষ্ট মন্দ হতে যাবে কেন, ভেবে অশােকের হাসি পেল। লােকটির কি অপূর্ব বিনয় !
চক্রবর্তী বলে চললেন, অদৃষ্ট মন্দ না হলে এমনটা হয়! সাতপুরুষের জমি আমার তাতে আর একজন ভােগা দেবার চেষ্টা করে! আপনার বাবার কাছে যতক্ষণ মােকদ্দমা আছে ভাবনা নেই, উনি বিচক্ষণ হাকিম, চট করে সাজানাে মামলা ধরে ফেলবেন! কিন্তু তা কি থাকবে! দেবে হয়তাে এক দরখাস্ত ঝেড়ে, কোন কাঠখােট্টা হাকিমের হাতে গিয়ে পড়বে ঈশ্বরই জানেন। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিল, অশােক উঠে দাঁড়িয়ে বললে, আজ আসি চক্রবর্তী মশাই।

চক্রবর্তীও উঠে দাঁড়ালেন, আসবেন? যা তাে মা নেকী একটা আলাে নিয়ে সঙ্গে। না, না আলাে লাগবে না, এখনাে অন্ধকার হয়নি। এটুকু বেশ যেতে পারব। চক্রবর্তী জিব কেটে বললেন, আরে বা রে! তা কি হয়? গ্রীষ্মকাল, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পথ। একটা লণ্ঠন নিয়ে এগিয়ে দিয়ে আসুক। অশােকের ইচ্ছা হল বলে, আপনিই আলাে নিয়ে চলুন না মশাই? রােগা মেয়েটাকে হয় নাই পাঠালেন। এরকম ইচ্ছা দমন করতে হয়। অশােকও করল। নেকী একটা আলাে জ্বেলে নিয়ে তার সঙ্গে চলল।
বাগানের মাঝখানে হঠাৎ দাঁড়িয়ে নেকী বলল, অশােকবাবু আমার একটা অনুরােধ রাখবেন?
অশােক হেসে বলল, মস্ত ভূমিকা, অনুরােধ ছােট হলে চলবে না। -না, ছােট নয়।
নেকী একটা ঢােক গিললে। আলােটা এমন ভাবে ধরলে যে মুখটা তার অন্ধকারেই রইল। একটু চুপ করে থেকে বলল, মামা যে জমির কথা বলছিলেন সেটা সত্যি সত্যি আমাদের। আপনার বাবাকে একটু বলবেন?

সম্মুখে সাপ দেখলে যেমন মানুষ চমকে ওঠে অশােক তেমনি চমকে উঠল। অন্য অবস্থায় এ অনুরােধটা অশােকের কাছে এত কদর্য ঠেকত না। সরলভাবে নেকী যদি এই অনুরােধ জানাত অশােক মৃদু হেসে তাকে বিচারকের কর্তব্যের কথাটা বুঝিয়ে দিত। নেকীর অজ্ঞতায় কৌতুক অনুভব করত। কিন্তু এ ষড়যন্ত্র ! তাকে ভুলিয়ে আদর দিয়ে, নেমন্তন্ন করে খাইয়ে, শতরকমভাবে ঘনিষ্ঠতার বন্ধনে বাঁধবার চেষ্টা করে এমনিভাবে এই নির্জন আমবাগানে এ অনুরােধ করার আর কোনাে অর্থই তাে হয় না। টাকা নয়, কিন্তু আদর যত্নও তাে ঘুষের রূপ নিতে পারে! হয়তাে এই মেয়েটার রূপচক্রবর্তী নিজের মুখে না জানিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকার নির্জনে সুন্দরী তরুণীকে দিয়ে এ অনুরােধ করার আর কি মনে হয়? ঘৃণায় অশােকের অন্তর সংকুচিত হয়ে গেল। গম্ভীর কণ্ঠে বললে, তােমার এ অনুরােধের অর্থ জান?




আরও পড়ুনঃ গল্পঃ ঝড় 

নেকীর গলা কেঁপে গেল, আমরা বড় গরীব অশােকবাবু।
অন্য সময় এই কণ্ঠস্বর শুনলে অশােকের হয়তাে করুণা হত, এখন হল রাগ, বললে, গরীব বলে তােমাদের জন্য আমাকে অন্যায় করতে হবে নাকি?
অন্যায় তাে নয়। জমিটা আমাদের। আমার কথা আপনার বিশ্বাস হয় না?
তিক্তস্বরে অশােক বলল, না, হয় না। হলেও জমি তােমাদের কি অন্যের সে মীমাংসা হবে আদালতে সাক্ষী প্রমাণ দিয়ে। তােমার অনুরােধ যে আমাকে আর আমার বাবাকে কতদূর অপমান করতে পারে সে ধারণা তােমার নেই বলেই নিঃসংকোচে জানাতে পারলে। নেকী কি বলতে গিয়ে সামলে নিলে। একটা নিশ্বাস ফেলে বললে- চলুন। থাক, তােমার আর কষ্ট করবার দরকার নেই।
নেকীর মুখ দেখা গেল না, দেখলে অশােক ভয় পেয়ে যেত। বললে, অতিরিক্ত সাধুতা ফলাবেন না অশােকবাবু!

অহেতুক দংশন। অন্তরে জ্বালা ধরলে, কারণ যাই হােক, এই রকম যুক্তিহীন কথাই মুখ দিয়ে বার হয়। অশােক কিন্তু তা বুঝলে না, বললে, সাধুতা-অসাধুতার তফাৎ বুঝবার ক্ষমতা তােমার নেই, তাই একথার জবাব দিলাম না। আমার সব চেয়ে বড় দুঃখ লীলা, ভগবানের দেওয়া রূপকে তুমি তুচ্ছ ঘুষের মতাে ব্যবহার করলে!
অন্তরে ওই কথাটাই বড় যন্ত্রণা দিচ্ছিল, তীক্ষ কাটার মতাে বিধছিল; অসতর্ক মুহূর্তে অশােকের শিক্ষা দীক্ষা মার্জিত বুদ্ধি সকলের বাধা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এল। এমন বিশ্রী শশানাল যে অশােক নিজেই চমকে উঠল। নেকীর হাত থেকে আলােটা পড়ে গিয়ে বার কয়েক দপদপ করে জ্বলে নিভে গেল। পুলক ভয় পেয়ে গিয়েছিল, অশােকের একটা হাত ধরে বললে, বাড়ি চল দাদা। বাড়ি? চল। 

অশােক মনকে বােঝাল, নতুন একটা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হল, মন্দ কি! ফুলে যে কীট থাকে সে তত্ত্বটা তাে জানাই ছিল! এবার থেকে সাবধান হওয়া যাবে। উঃ, কি রকম। জড়িয়ে জড়িয়ে বাঁধছিল! মুক্তি পেলাম, বাঁচা গেল। মুক্তিও বটে, বাঁচাও বটে। দুটোর একটার চিহ্নও অশােক খুঁজে পেল না। বাঁধনও খসেছে মনে করতেই বাঁধনে টান পড়ল। যা নেই জানল, তারই টানে টানে পাকে পাকে হৃদয় ভেঙে পড়তে চায় দেখে অশােক চমকে গেল। অশােক দেখে অবাক হয়ে গেল, নেকীকে সে যেভাবে ভাবতে চায় নেকী সে ভাবে ধরা দেয় না। মনে হয়, তার বিতৃয়া যেন তার চোখের সামনে কুয়াশা রচনা করে দিয়েছে, সেই কুয়াশার ভেতর দিয়ে নেকীকে সে নিষ্প্রভ দেখছে কিন্তু কুয়াশার ওদিকে নেকী তেমন উজ্জ্বল হয়েই আছে। অশােক ধরতে পারে না, কিন্তু তার মনে হয় কোথায় যেন ভুল হয়েছে। খোঁজে। হদিশ মেলে না।

রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে অন্ধকারে সে আগাগােড়া একবার ভেবে নিল। হঠাৎ ভুলটা ধরা পড়ে গেল।
চক্রবর্তী! হৃদয় চক্রবর্তী! ঠিক!
অশােক ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল। মূখ, মূখ! নিতান্ত মূখ সে। সবটুকু যে হৃদয় চক্রবর্তীর খেলা এটুকু বুঝবার ক্ষমতাও তার নেই! মামা আদেশ করলে তার কথা নেকী কেমন করে অস্বীকার করবে? আজ এক মাস যার সঙ্গে পরিচয়, যার চরিত্রের এতটুকু অংশ তার কাছে গােপন নেই, তাকে কি করে এতখানি হীন বলে সে মনে করল? নেকীর তাে বিন্দুমাত্র অপরাধ নেই! অশােকের বুক থেকে মস্ত একটা ভার নেমে গেল। 




বন্ধনের যে দড়িদড়াগুলি এতক্ষণ বেদনা দিচ্ছিল হঠাৎ সেগুলি হয়ে গেল ফুলের মালা। খুব ভােরে হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই অশােক আমবাগানে চলে গেল। পুকুর ধারে ঘাটের কাছে একটা তালগাছ কাত হয়ে পড়েছিল, তার খুঁড়ির ওপর বসে সরু বাঁকা পথটির দিকে চেয়ে রইল। একগােছা বাসন হাতে নিয়ে ঝােপ ঘুরে পুকুরের তীরে এসে অশােকের দিকে নজর পড়তেই নেকী থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। একরাত্রে তার ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। চোখ লাল, চোখের কোলে কালি! কাল বিকালে অতি যত্নে কবরী রচনা করেছিল, কার জন্য বুঝে কাল অশােকের খুশির সীমা থাকেনি। আজ সে কবরী বিশৃঙ্খল হয়ে গেছে। অশােকের বুক টন টন করে উঠল। কাছে এসে বললে, লীলা, আমায় মাপ কর। নেকীর সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল। জবাব দিতে পারল না। অশােক আবার বললে, আমি বুঝতে পারিনি লীলা। তােমার কোনাে দোষ ছিল না। ছিল না?

অশােক ভুল করলে, বললে, না। আমি জানি তােমার মামার জন্যেই আপনার পায়ে পড়ি অশােকবাবু, যে নীচ, ভগবানের দেওয়া রূপকে যে ঘুষের মতাে ব্যবহার করে, দয়া করে তাকে নিচেই থাকতে দিন। বলে নেকী অগ্রসর হল, অশােক পথ ছেড়ে দিল। তার অস্বাভাবিক বিবর্ণ মুখের দিকে চেয়ে দাঁত দিয়ে ঠোট কামড়ে ধরে নেকী ঘাটে নেমে গেল। পরদিন অশােক কলকাতা রওনা হল।
মাস তিনেক পরের কথা।
সকালে মার কাছ থেকে অশােক একখানা চিঠি পেল। মা লিখেছেন, মাসখানেক ধরে তিনি জ্বরে ভুগছেন, খুব সম্ভব ম্যালেরিয়া ধরেছে। ডাক্তার চিকিৎসা করতে যেতে বলেছেন, রাঁচি যাওয়া ঠিক হয়েছে। অশােকের বাবার ছুটি নেই, রাঁচি পর্যন্ত যেতে পারবে না। কলকাতায় পৌঁছে দিয়ে তিনি ফিরে যাবেন, কলকাতা থেকে অশােককে সঙ্গে যেতে হবে। সে যেন প্রস্তুত হয়ে থাকে। চিঠি পড়ে অশােক মিনিট পনেরাে ভাবল, তারপর সুটকেশ গােছাতে বসল। সেইদিন রাত্রের সিরাজগঞ্জ মেলে উঠে বসল।

মা বললেন, তাের তাে আসবার দরকার ছিল না। আমরাই তাে কলকাতা যাচ্ছিলাম। যাক, বেশ করেছিস।
অশােক মুখ নত করলে। কেন যে এল, সে প্রশ্নের বিরামহীন মহলা তো তার মনেই চলেছে! জবাব দেবে কি।
তাের কি কোনাে অসুখ হয়েছিল অশোেক?
অশােক ঘাড় নেড়েই প্রশ্ন করল, পুলকের স্কুল তাে ছুটি হয়নি? ওকি এখানে থাকবে?
কথা ঘুরিয়ে নেবার জন্য ছেলের প্রয়াস দেখে মার চোখে জল এল। বললেন, থাকবে? থাকবার ছেলেই বটে! আর জানিস, নেকী আমাদের সঙ্গে যাবে। অশােক চমকে উঠল। মেয়েটা একেবারে শেষ হয়ে গেছে রে! তুই থাকতেই ম্যালেরিয়া ধরেছিল, এখন কালাজ্বরে দাঁড়িয়েছে! অত্যাচারের তাে সীমা ছিল না। জ্বর গায়ে ক’বার যে স্নান করত ঠিক নেই। 

কী চেহারা হয়ে গেছে! মা একটা নিশ্বাস ফেলে চলে গেলেন। মার চলে যাওয়ার আসল উদ্দেশ্য এবার আর অশােকের কাছে গােপন রইল না। নেকী অল্প অল্প হাঁটতে পারত, কিন্তু আমবাগান পার হয়ে আসবার তার ক্ষমতা ছিল না। মা পাল্কী নিয়ে গিয়ে নিজে তাকে নিয়ে এলেন। অশােক উঠানে দাঁড়িয়েছিল, পাল্কীর খােলা দরজা দিয়ে তার দিকে চেয়ে নেকী ম্লান হাসি হাসল। রাগ নেই, দ্বেষ। নেই, অভিমান নেই, সারারাত্রি ঝড়ের আঘাত সয়ে রজনীগন্ধার দল ভােরবেলা যেমন শ্রান্ত ক্লান্ত হাসি হাসে সেইরকম হাসি। অশােক মুখ ফিরিয়ে নিল। নেকীর পিসীর অসুখ, চক্রবর্তীর তাই এই সঙ্গে যাওয়া হল না। পিসী একটু ভালাে হলেই যাবেন। যাত্রা করবার সময় ভদ্রলােক হাউ-মাউ করে কেঁদে ফেললেন, অশােকের মাকে উদ্দেশ্য করে বিকৃত কণ্ঠে বললেন, আমার আর কেউ নেই মা, ওকে আপনি ফিরিয়ে আনবেন। চক্রবর্তীর ওপর অশােকের আর বিতৃষ্ণার সীমা ছিল না, আজ তার মনে হল এর চেয়ে ভালাে লােক বােধহয় পৃথিবীতে নেই।





শহরের প্রান্তবাহী ছােট নদীটি বর্ষার জলে ভরে উঠেছে। স্টিমার ঘাট পর্যন্ত গাড়ি যায় না, নৌকায় যেতে হয়। স্টিমার ঘাট শহর থেকে মাইল পাঁচেক দূরে। স্টিমারে উঠে নেকী কেবিনে ঢুকতে রাজী হল না। রেলিঙের পাশে ডেক চেয়ার পেতে তাকে বসিয়ে দেওয়া হল। অশােক আর তার মা কাছে বসলেন। নেকী একদৃষ্টে মেঘনার জলরাশির দিকে চেয়ে রইল, স্টিমার এক তীর ঘেঁষে চলেছে, ওপারের তটরেখা অস্পষ্ট। দুবছর আগে এই পথ দিয়েই সে একটা অতি পরিচিত জীবনকে পিছনে ফেলে দুরু দুরু বুকে অজানা অচেনা জীবনের মাঝে গিয়ে পড়েছিল। আজ আবার সেই পথেই কোন নুতন জীবনের সন্ধানে সে চলেছে কে জানে! 

দেনা-পাওনা হয়ত মিটবে না, ওপারের তটরেখার মতই অস্পষ্ট অনুভূতি তাকে যে চিরন্তন জীবনের কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে সে জীবনে যেতে মন হয়ত তার কেঁদেই উঠবে! কিন্তু যেতে বােধহয় হবেই। অশােক শুষ্ক বিষন্ন মুখে ডেকের পাটাতনের দিকে চেয়ে রইল। মা-ই কেবল মাঝে মাঝে দু-একটা কথা বলতে লাগলেন। পুলকের এই সমস্ত উচ্চাঙ্গের সুখ-দুঃখের বালাই নেই, রেলিঙে ভর দিয়ে তন্ময় হয়ে সে ঢেউয়ের ওঠানামা দেখতে লাগল। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে মা বললেন, তােরা গল্প কর অশােক, আমার ভারি মাথা ধরেছে, কেবিনে একটু ঘুমিয়ে নিই গে। মা উঠে যেতেই অশােকের মুখের দিকে চেয়ে নেকী একটু হাসল। যেন বলতে চায় রাগ তাে তােমারও নেই তবে কথা বলছ না কেন?

চেয়ারটা নেকীর কাছে সরিয়ে এনে তার মুখের উপর ব্যাকুল দৃষ্টি মেলে অশােক বললে, আমায় মাপ করেছ লীলা?
নেকী তেমনিভাবে হেসে বললে, মাপ করবার কিছুই নেই, সেসব আমি ভুলে গেছি। তুচ্ছ ব্যাপারটাকে বড় করে দেখবার আর আমার শক্তিও নেই, সময়ও বােধহয় নেই। অশােকের চোখে জল এল, বললে, আমিই তােমায় শেষ করে দিলাম লীলা। নেকী তাড়াতাড়ি বললে, না না, ওকথা বােলাে না। হঠাৎ অশােকের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল, কতগুলি সাদা পাখি সার বেঁধে চলেছে দেখ। বক তাে নয়!
অশােক দেখল। বললে, না বুনাে হাঁস।
হাঁস? ওমা! এ আবার কিরকম হাঁস। আচ্ছা, ওরা দল বেঁধে কোথায় চলেছে?
বেড়াতে বেরিয়েছে বুঝি?

অশােক বুঝল। একেবারে নেকীর পাশে সরে এল। নেকীর একখানা হাত নিজের হাতের ওপর গ্রহণ করে বললে, ওদের তাে বাড়ি-ঘর নেই, ওরা বেড়িয়েই বেড়ায়। তুচ্ছ কথার অন্তরালে অনাড়ম্বর চেষ্টায় এতদিনের বিচ্ছেদের সংকোচ মুছে ফেলাই সব চেয়ে সহজ। সত্যি! বাড়ি-ঘর না থাকাই কিন্তু বেশ! না?
বাতাসে একরাশি রুক্ষ্ম চুল। নেকীর মুখের ওপর এসে পড়েছিল। অশােক সযত্নে চুলগুলি সরিয়ে দিল।

 আরামে নেকীর চোখ বুজে এল। নিঃশব্দে অশােকের আঙুলের মৃদু স্পর্শটুকু সমস্ত মন দিয়ে উপভােগ করে চোখ মেলে অশােকের মুখের দিকে চেয়ে লজ্জিত সুখের হাসি হেসে বললে, ঘুম পাচ্ছে, ঘুমােই?
ঘুমােও।
নেকীর হাতখানি হাতের মুঠে ধরা রইল। নেকীর মুখের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নীল আকাশের বুকে সঞ্চরণশীল শ্বেত চন্দনের ফোঁটার মত গতিশীল বুনাে হাঁসগুলির দিকে চেয়ে রইল। শ্রাবণের আকাশ, কিন্তু মেঘ নেই। ওপারের অস্পষ্ট তটরেখা অস্পষ্ট হয়েই রইল। অশােক মনে মনে বললে, তাই থাক। যে তীর ঘেঁষে চলেছি সেই তীর স্পষ্টতর হােক, ওপারের তটরেখা আরও অস্পষ্ট হয়ে মিলিয়ে যাক।

@👉 Bangla Romantic Love Stories গল্পটি পড়ে যদি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই শেয়ার এবং কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না…..                            
WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now

Leave a Comment