পাওয়ার জন্য আমাদের ব্লগ টিকে সাবস্ক্রাইব করে আমাদের সাথে থাকুন, গল্পটি পড়িয়া যদি আপনার ভালো লাগিয়া থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করিয়া জানাইতে ভুলিবেন না।
আজকের গল্প – রোমান্স
ছোটনাগপুরের যে অখ্যাতনামা স্টেশনে হাওয়া বদলাইতে গিয়াছিলাম তাহার নাম বলিব না। পেশাদার হাওয়া-বদলকারীরা স্থানটির সন্ধান পায় নাই। এখনো সেখানে টাকায় ষোলো সের দুধ এবং দুই আনায় একটি হৃষ্টপুষ্ট মুরগী পাওয়া যায়। কিন্তু চাঁদেও কলঙ্ক আছে। কবির ভাষায় বলিতে গেলে ‘দোসর জন নহি সঙ্গ’। দিনান্তে মন খুলিয়া দুটা কথা বলিব এমন লোক নাই। পোস্টমাস্টার বাবু আছেন বটে, কিন্তু তাহার বয়স হইয়াছে এবং মেজাজ অত্যন্ত করা। তা ছাড়া স্টেশনের মালবাবুটি আছেন বাঙালি। কিন্তু তিনি রেলের মাল ও বোতলের মালের মধ্যে নিজেকে এমন নিঃশেষে বিলাইয়া দিয়াছেন যে সামাজিক মনুষ্য হিসাবে তাহার আর অস্তিত্ব নাই।
দুগ্ধ ও কুক্কুট মাংসের সুলভতা সত্ত্বেও বিলক্ষণ কাতর হইয়া পরিয়াছিলাম। দিন এবং রাত্রি কোনো মতে কাটিয়া যাইতো। কিন্তু বৈকাল বেলাটা সত্যই অচল হইয়া উঠিয়াছিলো। যৌবনের বানপ্রস্থ অবলম্বনের যে বিধি ঠাকুর কবি দিয়াছেন, তাহাতে সঙ্গী বা সঙ্গিনী গ্রহণ করিবার ব্যাবস্থা থাকিলে আমার আপত্তি নাই, নচেৎ-প্রস্তাবটা পুরা-মাত্রায় গ্রহণ করিতে পারিতেছি না। যৌবনকালে অবিবাহিত অবস্থায় একাকী হাওয়া বদলাইতে আসিয়া ব্যাপারের গুরুত্ব উপলদ্ধি করিতে পারিয়াছি। কিন্তু দু-চার দিন কাটিবার পর সন্ধাযাপন করিবার একটা চমৎকার উপায় আবিস্কার করিয়া ফেলিলাম। রেলের স্টেশনটি নিরিবিলি। লম্বা নিচু প্লাটফর্ম এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত চলিয়া গিয়াছে- ওপরে কোনো প্রকার ছাউনি নাই। মাঝে মাঝে একটি করিয়া বেঞ্চি পাতা আছে। একদিন বৈকাল নিতান্ত হতাশ্বাস হইয়া একটি বেঞ্চির ওপর গিয়া বসিয়া পড়িলাম। মিনিট কয়েক পরে স্টেশনে সামান্য একটু চাঞ্চল্য দেখাদিল। তারপরই হু-হু শব্দে পশ্চিম হইতে কলিকাতা-যাত্রী মেইল আসিয়া পড়িল। যাত্রীর নামা-ওঠার উত্তেজনা নাই বলিলেই চলে।
কিন্তু সারা গাড়িটা যেন মনুষ্যজাতির বিচিত্র সমাবেশে গুলজার হইয়া আছে। জানালা দিয়ে কত প্রকারের স্ত্রী-পুরুষ গলা বাড়াইয়া আছে, কলরব করিতেছে। ফাস্টক্লাসে দু-চারিটি ইঙ্গ-সাহেব-মেম নিজেদের চারিপাশে স্বতন্ত্রতার দুর্ভেদ্য পরিমণ্ডল সৃষ্টি করিয়া গম্ভির মুখে বসিয়া আছে। ঘর্মাক্ত কলেবর অর্ধ উলঙ্গ ইঞ্জিন ড্রাইভারটা যেন এক চক্কর কুস্তি লরিয়া ক্ষনিকের জন্য মল্লভুমির বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইয়াচে। মনে হইল, আমার চোঁখের সামনে লোহার খাঁচায় পোড়া একটা ধাবমান মিছিল আসিয়া দাঁড়াইল। এক মিনিট দাঁড়াইয়া ট্রেন-দৈত্য আবার ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল। এখানে তাহার কোনোই কাজ ছিলনা, শুধু হাঁফ লইবার জন্য একবার দাঁড়াইয়াছিলো। কিন্তু আমার মনে একটা নেশা ধরাইয়া দিয়া গেল। এই আকস্মিক দুর্যোগের মতো হঠাৎ আসিয়া হাজির হওয়া। তারপর তেমনই আকস্মিকভাবে উধাও হইয়া যাওয়া- ইহার মধ্যে যেন একটা Romance রহিয়াছে।
জীবনের গতানুগতিক ধারার মধ্যে একটি বৈচিত্র্য আসিয়া প্রাণকে নাড়া দিয়া সজাগ করা দেয়-ইহাই তো রোমান্স! স্টেশন আবার খালি হইয়া গিয়াছিল। বেশ একটু প্রফুল্লতা লইয়া উঠি উঠি করিতেছি, ঠং ঠং করিয়া স্টেশনের ঘন্টা বাজিয়া উঠিল। সচকিতে গলা বাড়াইয়া দেখিলাম, বিপরীত দিক হইতে ট্রেন আসিতেছে। আবার বসিয়া পড়িলাম। ইনিও মেল, কলিকাতা হইতে পশ্চিমে যাইতেছেন। তেমনই বিচিত্র স্ত্রী-পুরুষের ভিড়। জানালার প্রতিফ্রেমে চলচিত্রের একটি দৃশ্য। তার পর সেই খাঁচায় পোড়া দীর্ঘ মিছিল লোহা-লক্কর বাষ্প ও কয়লার জয়গান করিতে করিতে চলিয়া গেল। স্টেশনে খবর লইয়া জানিলাম আজ আর কোনো ট্রেন আসিবে না। শিস দিতে দিতে বাড়ি ফিরিলাম। পরদিন বৈকালে আবার গেলাম। ক্রমে ক্রমে একটা দৈনন্দিন অভ্যাস হইয়া দাঁড়াইলো। এমন হইল যে ঘড়ির কাটা পাঁচটার দিকে সরিতে আরম্ভ করিলেই আমার পদযুগলও অনিবার্য টানে স্টেশনের দিকে সঞ্চালিত হইতে থাকে। আধ ঘন্টা সেখানে বসিয়া দুটি ট্রেনের যাতায়াত দেখিয়া তৃপ্ত মনে ফিরিয়া আসি। কোনও ট্রেন কোনও দিন একটু বিলম্বে আসিলে উদ্বিগ্ন হইয়া উঠি। নিজের উৎকণ্ঠায় নিজেরই হাসি পায়, তবু উৎকণ্ঠা দমন করিতে পারি না। যেন ইহাদের যথা সময়ে আসা না আসার দায়িত্ব কতকটা আমারই স্কন্ধে।
সেদিনের কথাটা খুব ভালো মনে আছে। ফাল্গুনের মাঝামাঝি-ঝিরঝিরে বাতাস স্টেশনের ধারের ছোট ছোট পলাশ গাছের পাতার ভিতর দিয়া লুকোচুরি খেলিতেছিলো। আকাশের কয়েক খণ্ড হালকা মেঘ অস্তমান সূর্য হইতে আলো সংগ্রহ করিয়া চারিদিকে ছড়াইয়া দিতেছিলো। বাতাসের রং গোলাপি হইয়া উঠিয়াছিলো। কনে-দেখানো আলো, এ আলোর নাকি এমনই ইন্দ্রজাল আছে যে চলনসই মেয়েকেও সুন্দর মনে হয়। স্টেশনে গিয়া বসিয়াছি, মনে এই কনে-দেখানো গোলাপী আলোর ছোপ ধরিয়া গিয়াছে। এমন সময় বংশীধ্বনি করিয়া কলিকাতা- যাত্রী মেল আসিয়া দাঁড়াইল। গাড়ির যে কামরাটা ঠিক আমার সম্মুখে আসিয়া থামিয়াছিল, তাহারই একটা জানালা আমার চোখের দৃস্টিকে চুম্বকের মতো টানিয়া লইল।
জানালার ফ্রেমে একটি মেয়ের মুখ। কনে-দেখানো আলো সেই মুখখানির উপর পড়িয়াছে বটে কিন্তু না পড়লেও ক্ষতি ছিলনা। এত মিষ্টি মুখ আর কখনো দেখিনাই। চুলগুলি অযত্নে জড়ানো, চোখ দুটি স্বপ্ন দেখিতেছে। আমার ওপর তাহার চক্ষু পড়িল, তবু সে আমাকে দেখিতে পাইল না।
বাহিরের দিকে তাহার দৃষ্টি নাই। যৌবনের অভিনব স্বপ্নরাজ্যে নূতন প্রবেশ করিয়াছে, তাহারই ঘোর চোখে লাগিয়া আছে। মনের বনচারিণী। অন্তরের কৌমার্য চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। শিলারুদ্ধ পথ তটিনীর মতো পথ খুজিতেছে কিন্তু শিলা ভাঙিয়া ফেলিবার সাহস এখনো হয়নাই। যৌবনের তটে দাঁড়াইয়া তাহার পা দুটি ন যযৌ ন ততস্থই।
গাড়ির কিন্তু ন যযৌ ন ততস্থই নাই। এক মিনিট কখন কাটিয়া গেল, গাড়ি গোলাপি বাতাসের ভিতর দিয়া চলিতে আরম্ভ করিল। আমার দৃষ্টির চুম্বক দিয়া লোহার গাড়িটা টানিয়া রাখিবার চেষ্টা করিলাম। গাড়ি কিন্তু থামিল না। তারপর কতক্ষন সেখানে বসিয়া রহিলাম। পশ্চিমগামী গাড়ি আসিয়া চলিয়া গেল জানিতেও পারিলাম না। চমক ভাঙিতে দেখিলাম, ফাগুনের হালকা বাতাস তখন পলাশ পাতার ভিতর দিয়া লুকোচুরি খেলিয়া ফিরিতেছে কিন্তু আকাশের কনে-দেখানো আলো আর নাই, কখন মিলাইয়া গিয়াছে। রাত্রে বিছানায় শুইয়া ভাবিতে লাগিলাম। বাঙালি মেয়ে নিশ্চয়। এত সুকুমার মুখ বাঙালির মেয়ে ছাড়া হয়না। কিন্তু পশ্চিম হইতে আসিতেছে।
তা পশ্চিমে তো কত বাঙালি বাস করে। কোথায় যাইতেছে? হয়তো কলিকাতায় কিংবা আগেও নামিয়া যাইতে পারে! কোথায় বর্ধমান? চন্দননগর? বাংলা দেশটা তো এতটুকু নয়। এই বিপুল জনসমুদ্রে এক বিন্দু শিশিরের মতো কে কোথায় মিলাইয়া যাবে! কৌতূহলী জল্পনা চলিতে লাগিল। মন নিজের কাছে ধরা পরিয়া গিয়াও বিন্দু মাত্র লজ্জিত হইলো না। আবার কখনো দেখা হইবে কি? ইংরেজি বচন মনে পড়িল- Ships that pass in the night! না, তা হইতে পারেনা। একবারমাত্র চোখের দেখায় যে মনের উপর এমন দাগ কাটিয়া দিল, সে চিরজীবনের মতো অদৃশ্য হইয়া যাইবে। আর তাহাকে কখনো দেখিতে পাইব না। আশ্চর্য! এমন তো কত লোককেই প্রত্যহ দেখিতেছি, কাহারও পানে ফিরিয়া তাকাইবার ইচ্ছাও হয় না। আয়নার প্রতিবিম্বের মতো চোখের আড়াল হওয়ার সঙ্গে মনের আড়াল হইয়া যায়। অথচ এই মেয়েটি এক মিনিটের সমস্ত মন জুড়িয়া বসিল কি করিয়া। সে কুমারী- আমার মন বুঝিয়াছে।
তাছাড়া সিঁথিতে সিন্দুর, মাথায় আঁচল ছিল না। ঠোঁট দুটিও অনাঘ্রাত কচি কিশলয়ের মতো- তবে? কে বলিতে পারে? জগতে এমন কত বিচিত্র ব্যাপারই তো ঘটিতেছে। হয়তো আমারই জন্য সে। মন তাহাকে লইয়া মাধুর্যের হোলি খেলায় মত্ত হইয়া উঠিল। পর দিন অভ্যাস মতো আবার স্টেশনে গেলাম। দুটি গাড়িই পর পর বিপরীত মুখে চলিয়াগেল। আজ তাহাদের ভালো করিয়া লক্ষই করিলাম না, মন ও ইন্দ্রিয় গুলি অন্তর্মূখী। বর্হিজগৎ যেন ছায়াময় হইয়া গিয়াছে। হঠাৎ মাথার ভিতর দিয়া তড়িৎ খেলিয়া গেল। কে বলিতে পারে হয়তো এই পথে সে ফিরিয়া যাইবে। কোথা হইতে আসিয়াছিল জানি না, কোথায় গিয়াছে তাহাও অজ্ঞাত। তবু এই পথেই ফিরিতে পারে তো! পরদিন হইতে আবার সতর্কতা ফিরিয়া আসিল। শুধু তাই নয়, এত দিন যাহা ছিল নৈর্ব্যক্তিক কৌতূহল তাহাই নিতান্ত ব্যাক্তিগত প্রয়োজন হইয়া দাঁড়াইল।
পশ্চিম যাত্রী গাড়ি আসিলে আর চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতে পারিনা। সময় অল্প তবু সমস্ত প্লাটফর্ম ঘুরিয়া সব জানালা গুলো অনুসন্ধান করিয়া দেখি। হঠাৎ জানালায় কোনও মেয়ের মুখ দেখিয়া বুক ধড়াস করিয়া উঠে। তার পর বুঝিতে পারি এ সে নয়। মাঝে মাঝে মনে সংশয় উপস্থিত হয়, সপ্তাহ কাটিয়া গেল, কই ফিরিল না তো! তবে কি অন্য পথে ফিরিয়া গিয়াছে? কিংবা-যদি না ফেরে? হয়তো চিরদিনের জন্য Bangladesh এ থাকিয়া যাইবে। এমনও তো হইতে পারে, পশ্চিমে বেড়াইতে গিয়েছিল, ফিরিবার পথে আমি তাহাকে দেখিয়াছি। তবে, আমি যে প্রত্যহ সন্ধ্যাবেলা ট্রেন সন্ধান করিতেছি, ইহা তো নিছক পাগলামি। আবার কখনো কখনো মনের ভিতর হইতে একটা দৃঢ় প্রত্যয় উঠিয়া আসে। দেখা হইবেই, তাহাকে মনের মধ্যে এত ঘনিষ্ঠ ভাবে পাইয়াছি যে সে আমার মনের ঘরণী হইয়া দাড়াইছে। তাহাকে আর চোখে দেখতে পাইব না, এ হইতেই পারে না।
কল্পনা করি- দেখা হলে কি করিব, গাড়িতে উঠিয়া বসিব? কিংবা এই বেঞ্চিতে বসিয়া হাতছানি দিয়া তাহাকে ডাকিব। সে একটি কথা বলিবে না, গাড়ি হইতে নামিয়া আমার সামনে স্মিত মুখে আসিয়া দাঁড়াইবে। দুজন হাত-ধরাধরি করিয়া স্টেশনের বাহির হইয়া যাইব। পাথুরে কাঁকর-ঢালা পথ দিয়া গৃহে ফিরিতে ফিরিতে এক সময়ে জিজ্ঞাসা করিব- এত দেরি করিলে কেন? কিন্তু তাহার দেখা নাই। তার পর একদিন- সেদিনের কথাও বেশ মনে আছে। পশ্চিম গামী মেল আসিয়া দাঁড়াইলো। বেঞ্চি হইতে উঠিতে হইলো না, ঠিক সামনের জানালায় সে। বারো দিন পরে আবার ফিরিয়া চলিয়াছে। লাল চেলিতে তাহার সর্বাঙ্গ ঢাকা, সিঁথিতে অনভ্যস্ত সিন্দুর লেপিয়া গিয়াছে। চোখের চাহনি তেমনই স্বপ্নাতুর, আমার উপর তাহার দৃষ্টি পড়িল, কিন্তু এবারও সে আমায় দেখিতে পাইল না। মনের বনচারিণী, কিন্তু তবু আজ কোথায় একটা মস্ত তফাৎ হইয়া গিয়াছে। সেদিন আকাশের কনে- দেখানো আলো যে বিভ্রম সৃষ্টি করিয়াছিল, আজ তাহা তাহার ভিতর হইতে পরিস্ফুট হইয়া উঠিতেছে। এক মিনিট, গাড়ি চলিয়া গেল, তার পর কতক্ষন বেঞ্চিতে বসিয়া রহিলাম। নিজের দীর্ঘ নিঃশ্বাসের শব্দে চমক ভাঙিতে দেখিলাম, ফাগুনের হালকা বাতাস পলাশ পাতার ভিতর দিয়া লুকোচুরি খেলিয়া ফিরিতেছে।