সিটি কলেজের প্রিন্সিপাল চৌধুরী সাহেবের ঘরে রায় সাহেবের ডাক পড়েছে। রায় সাহেব কারণটা ঠিক ধরতে পারছেন না। বিশেষ কোনো জরুরি কারণ ছাড়া চৌধুরী সাহেব কোনো শিক্ষককে তার ঘরে ডাকেন না। চৌধুরী সাহেব মানুষটা রাশভারী ধরনের। পুরনো কালের প্রিন্সিপালদের মতো হাবভাব। শুধু ছাত্র না, শিক্ষকরাও তাঁকে ভয় পান। তিনি অকারণে কাউকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠান না। যখন ডেকে পাঠান তখন বুঝতে হবে বিশেষ কিছু ঘটে গেছে। ভয়ঙ্কব কিছু। রায় সাহেব ঠিক বুঝতে পারছেন না তাঁর ক্ষেত্রে সেই ভয়ঙ্কর কিছুটা কী?
চৌধুরী সাহেব চিঠি লিখছিলেন, লেখা বন্ধ রেখে হাসি মুখে বললেন, রায় সাহেব বসুন।
রায় সাহেব বসতে বসতে বললেন, স্যার ডেকেছিলেন?
হ্যাঁ। আপনাদের সঙ্গে তো সামাজিক সৌজন্যের কথাবার্তাও হয় না। এমন ব্যস্ত থাকি। খবর কী বলুন তো?
খবর ভালো।
ক্লাস চলছে কেমন?
জি ভালো।
চা খাবেন?
জি না।
খান, আমার সঙ্গে এককাপ চা খান।
চৌধুরী সাহেব বেল টিপে বেয়ারাকে চা দিতে বললেন। রায় সাহেব বললেন, স্যার আপনি কি আমাকে বিশেষ কিছু বলার জন্যে ডেকেছেন?
চৌধুরী সাহেব অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, না বিশেষ কিছু না। আচ্ছা ভালো কথা, আপনি নাকি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রদের বলেছেন–মানুষের দুপায়ে হাঁটা উচিত না। চারপায়ে হামাগুড়ি দেয়া উচিত। এরকম কিছু কি বলেছেন?
জি বলেছি।
রসিকতা করে নিশ্চয়ই বলেছেন। আমাদের সমস্যা হচ্ছে কোনটা রসিকতা আর কোনটা রসিকতা না সেটা ধরতে পারি না। সিরিয়াস বিষয়গুলিকে রসিকতা মনে করি। আর রসিকতার বিষয়গুলিকে সিরিয়াসভাবে নিয়ে নিই। আই কিউ কম হলে যা হয়। জাতিগতভাবেই আমাদের আই কিউ কম।
আমি স্যার রসিকতা করি নি।
চৌধুরী সাহেবের মুখ হা হয়ে গেল। চা চলে এসেছে। তিনি চায়ের কাঁপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, আপনি ছাত্রদের হামাগুড়ি দিতে বলেছেন?
জি না। হামাগুড়ি দেয়ার উপকারিতাটা বলেছি।
চৌধুরী সাহেব হতভম্ব গলায় বললেন, কী উপকারিতা?
রায় সাহেব উপকারিতা ব্যাখ্যা করলেন। সুন্দর করে ব্যাখ্যা করলেন। চৌধুরী সাহেব অবাক হয়ে শুনলেন। এক সময় গলা খাকারি দিয়ে বললেন, আপনার যুক্তি ইন্টারেস্টিং বলে মনে হচ্ছে। তবে ব্যাপার হচ্ছে কী, একেবারে রেভৃলিশনারী ধারণার ব্যাপারে আমাদের অনেক সাবধান হতে হবে। আজ। আপনার কথা শুনে কলেজের সব ছাত্রছাত্রী যদি হামাগুড়ি দিয়ে চলাফেরা করতে শুরু করে সেটা কি ভালো হবে?
রায় সাহেব কিছু বললেন না। শান্ত মুখে চায়ের কাঁপে চুমুক দিলেন। চৌধুরী সাহেব বললেন, ক্লাসে বক্তৃতায় এইসব আমার মনে হয় না বলাই ভালো। তাছাড়া আপনার বিষয় হচ্ছে অঙ্ক। হামাগুড়ি তো আপনার বিষয় নয়। আপনি তো আর ড্রিল টিচার না। ঠিক না?
জি স্যার।
আবার শুনলাম মানুষের নামকরণ পদ্ধতিটাও নাকি আপনার কাছে ত্রুটিপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে।
আমরা যেভাবে নাম রাখি তাতে নাম থেকে চট করে কিছু বোঝা যায় না। মানুষের নাম এমন হওয়া উচিত যেন নাম শুনেই বলে দেয়া যায় মানুষটা বোকা না জ্ঞানী, বুদ্ধিমান না ধূর্ত। রাসায়নিক যৌগগুলির নাম যেমন শোনা মাত্র বোঝা যায় ব্যাপারটা কী। ১-৩ বিউটাডাইন বললেই আমরা জেনে যাই ১ ও ৩ পজিশনে ডাবল বন্ড আছে।
চৌধুরী সাহেব শুকনো গলায় বললেন, ও আচ্ছা।
স্যার আমি কি এখন উঠব?
বসুন, আরেকটু বসুন।
রায় সাহেব দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন, প্রিন্সিপাল সাহেবের কথায় আবার বসলেন।
চৌধুরী সাহেব বললেন, আপনার তো অনেক ছুটি পাওনা আছে, আপনি কিছুদিন ছুটি নিয়ে ঘুরে আসুন না কেন?
ছুটির কোনো প্রয়োজন দেখছি না স্যার।
ছুটির প্রয়োজন দেখবেন না কেন? ছুটির প্রয়োজন আছে। নগর জীবনের প্রবল চাপে আমাদের ভেতর নানান সমস্যা দেখা দেয়। এইসব সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে আমাদের মাঝে মাঝে ছুটি নেয়া খুব জরুরি হয়ে পড়ে। Far from the madding crowd, আপনি ছুটির দরখাস্ত করুন। আপনার ছুটি তো পাওনাও আছে, আছে না?
জি স্যার আছে।
তাহলে আর সমস্যা কী? আপনি এক কাজ করুন–সমুদ্র দেখে আসুন। রোগ সারানোয় সমুদ্রের মতো কিছু হয় না।
রায় সাহেব বললেন, স্যার আমার তো কোনো রোগ নেই।
জানি। সুস্থ মানুষের জন্যে সমুদ্র আরো বেশি সুফলদায়ক।
চৌধুরী সাহেব বেল টিপে বেয়ারাকে ডাকলেন। ছুটির ফর্ম আনতে বললেন। রায় সাহেবকে সাত দিনের ছুটি নিয়ে প্রিন্সিপাল সাহেবের ঘর থেকে বেরুতে হলো।
রায় সাহেব খুবই বিরক্ত বোধ করছেন। এই সাত দিন তিনি ঘরে বসে থেকে কী করবেন? পাহাড় সমুদ্র এইসব বিষয়ের প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহ নেই। মিলিদের সঙ্গে একবার সমুদ্র দেখতে গিয়েছিলেন, সমুদ্রের গর্জন শুনে মাথা ধরে গেল। রাতে আর ঘুম আসে না। গাদাখানিক জল দেখার মধ্যে লোকজন কী মজা পায় কে জানে।
তিনি টিচার্স কমন রুমে এসে বসলেন। হঠাৎ লক্ষ করলেন সবাই যেন কেমন কেমন দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। শামসুদ্দিন সাহেব গলাখাকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছেন রায় সাহেব?
ভালো। সাত দিনের ছুটি নিয়েছেন শুনলাম?
হুঁ।
সমুদ্র দেখতে যাচ্ছেন?
রায় সাহেব ভেবে পেলেন না। তাঁর ছুটির খবরটা ইতিমধ্যে জানাজানি হলো কীভাবে! তিনি তো কাউকে কিছু বলেন নি।
শামসুদ্দিন সাহেব বললেন, আপনার হামাগুড়ি থিওরি শুনলাম। অসাধারণ। বৈপ্লবিক বলা যেতে পাবে।
আপনার সে-রকম মনে হচ্ছে?
অবশ্যই মনে হচ্ছে। থিওরি অব রিলেটিভিটির পর এমন বৈপ্লবিক ধারণা আর আসে নি। কে কী বলবে না বলবে তা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। লোকে আপনাকে পাগল ভাবলেও আপনি কেয়ার করবেন না। গ্যালিলিও যখন বললেন, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে, তখন অনেকেই তাঁকে পাগল ভেবেছিলেন। মহান থিওরিব প্রচারকরা সবসময়ই পাগল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। গ্রেট ট্র্যাজেডি।
সুজন বাবু বললেন, আপনার থিওরি আমার কাছেও গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে। শুধু একটাই সমস্যা আমাদের দুজোড়া করে জুতা লাগবে। পায়ের জন্যে এক জোড়া, আবার হাতে পরার জন্যে আরেক জোড়া। হাতে পরা জুতার অন্য একটা নাম থাকা দরকার। হুতা নাম দিলে কেমন হয়? পায়েরটা জুতা আর হাতেরটা হুতা।
রায় সাহেবের সন্দেহ হলো এরা তাকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করছে। তাঁর মন বিষন্ন হলো। তিনি কাউকে নিয়ে রঙ্গ রসিকতা করেন না। তারা কেন তাকে নিয়ে করবে?
শামসুদ্দিন বললেন, শুধু হাতের জুতা থাকলেই হবে না হাঁটুর জন্যেও কিছু একটা দরকার। হামাগুড়ি দেয়ার সময় হাঁটু মাটিতে লাগে। চামড়া বা প্লাস্টিকের টুপি জাতীয় কিছু লাগবে হাঁটুর জন্যে। এইসব সমস্যা সমাধান করতে হবে।
সুজন বাবু বললেন, আর একটা বড় সমস্যার কথা আপনারা চিন্তাই করছেন না। পুজোর সময় রাস্তা-ঘাটের ভিড় লক্ষ করেছেন? চারপায়ে হাঁটলে অনেকখানি জায়গা নিয়ে নেবে। ভিড়ের অবস্থাটা হবে কী?
শামসুদ্দিন বললেন, এর একটা ভালো দিকও আছে। ছোট বাচ্চাকাচ্চারা ঘোড়ার মতো পিঠে বসে থাকবে। এরা ঘ্যানঘ্যান করবে না। আনন্দে থাকবে। ঘোড়ার পিঠের হাতির হাওদার মতো একটা হাওদা থাকলে বাচ্চারা পড়ে যাবে না। বেল্ট দিয়ে হাওদা কোমরের সঙ্গে বাধা থাকবে।
রায় সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। এইসব কথাবার্তা শুনতে তাঁর আর ভালো লাগছে না। আগামী সাত দিন তাঁর কিছু করার নেই–ভাবতেই খারাপ লাগছে। বাড়িতে ফিরতেও ইচ্ছা করছে না। আচ্ছা লোকজন কি তাঁকে পাগল ভাবতে শুরু করেছে? পাগলের কোনো আচরণ কি তিনি করছেন? মনে হয় না তো। অবশ্যি তিনি কোনো পাগলকে ভালোভাবে লক্ষ করেন নি। ছোটবেলায় মামার বাড়িতে একটা পাগল আসত। তাকে দেখে দৌড়ে ঘরে পালাতেন। তার আচার আচরণ ভালো মতো দেখা হয় নি। একটা বড় ভুল হয়েছে। এখন থেকে পাগল দেখলে খুব ভালো করে লক্ষ করতে হবে। দূর থেকে লক্ষ করা। কাছে যাওয়া যাবে না। তিনি কুকুর এবং পাগল এই দুই জিনিসকে বড়ই ভয় পান।
@ 👉 Bhuter Golpo টি পড়ে যদি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই শেয়ার এবং কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না.....