বিশ্বকর্মা পূজা পদ্ধতি, মন্ত্র, পূজার ফর্দ ও পূজার নিয়ম PDF

WhatsApp Channel Follow Now
Telegram Group Follow Now

বিশ্বকর্মা পূজা পদ্ধতি, মন্ত্র, পূজার ফর্দ ও পূজার নিয়ম PDF Download : হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী বিশ্বকর্মা দেবতাদের শিল্পী। তিনি সবার কাছে দেবশিল্পী নামে পরিচিত। বিষ্ণুপুরাণ মতে যোগসিদ্ধা বিশ্বকর্মার মাতা এবং অষ্টম বসু প্রভাস তাঁর পিতা। যোগসিদ্ধা হচ্ছেন দেবগুরু বৃহস্পতির ভগিনী। অষ্টম বসু প্রভাস হচ্ছেন ধর্মের ঔরসে দক্ষরাজার কন্যা বসুর্যার গর্ভের সন্তান। অষ্টবসু মানে আট জন গণ দেবতা। তাঁরা হলেন – ধর, ধ্রুব, সোম, অনিল, অনল, প্রত্যুষ, প্রভাষ ও দ্যু।

এই অষ্টবসু দক্ষরাজার কন্যা বসুর্যার পুত্র। বিশ্বকর্মার বাহন হাতি। বিশ্বকর্মা শুধু দেবশিল্পী নন, তিনি মর্ত্যবাসী মানবদেরও শিল্প প্রজাপতি। স্বর্গের অনান্য দেবতাদের মতো এই মর্ত্যলোকে তাঁরও পূজা হয়। তাঁর আশীর্বাদে মর্ত্যবাসীগণ শিল্পকাজে যথেষ্ট পারদর্শী হয়েছেন।

ঋকবেদে বিশ্বকর্মাকে সর্বদর্শী ভগবান হিসাবে উল্লেখ আছে। তাঁর চক্ষু, মুখমণ্ডল, বাহু ও পদদ্বয় সর্বদিক ব্যাপিয়া রয়েছে। বাহু ও পদদ্বয়ের সাহায্যে তিনি স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল অর্থাৎ ত্রিভুবন নির্মাণ করেছেন। তিনি শিল্প সমূহের প্রকাশক, অলঙ্কারের স্রষ্টা এবং দেবতাদের বিমান ও রথ নির্মাতা। দেবতাদের সকল অস্ত্র তাঁরই নির্মিত।

বিশ্বকর্মা পূজা পদ্ধতি

বিশ্বকর্মা পূজা পদ্ধতি

কারিগরী শিল্প যে, দেবতার আরাধনা ছাড়া অসম্পূর্ণ থেকে যায়, তিনি হলেন বিশ্বকর্মা। হিন্দুদের কাছে বিশ্বকর্মার আরাধনা একটি বড় ধর্মীয় উৎসব। ভাদ্রমাসের সংক্রান্তিতে দেবতাদের শিল্পের কারিগর বিশ্বকর্মার পুজো করা হয়।

হিন্দুদের অন্যান্য পূজার সময় চাঁদের গতি-প্রকৃতির উপর নির্ধারিত হলেও বিশ্বকর্মার পূজার সময় সূর্যের গতি প্রকৃতির উপর নির্ভর করে নির্ধারিত হয়। এই নিয়ম অনুসারে সূর্য যখন সিংহ রাশি থেকে কন্যা রাশিতে প্রবেশ করে তখন উত্তরায়ন শুরু হয়। এই সময়েই দেবতারা নিদ্রা থেকে জেগে ওঠেন এবং বিশ্বকর্মা পূজার আয়োজন শুরু করা হয়।

বিশ্বকর্মার সন্তুষ্টি অর্জন ও তার প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে কেবল প্রকৌশলী কিংবা স্থপতি সম্প্রদায় নয়, সব ধরনের কারিগর, সূতার, মিস্ত্রি, কামার-কুমার, স্বর্ণকার, শিল্প কর্মী, কারখানার শ্রমিক, ঢালাইকর সহ অনেক ধরনের পেশার মানুষ এদিন তাঁর পূজা করে। তারা আরও উন্নত ভবিষ্যতের জন্য, নিরাপদ কাজের পরিস্থিতি এবং নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সর্বোপরি নিজ নিজ ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করে।

বিশ্বকর্মা পূজার ফর্দ

বিশ্বকর্মা পূজার দ্রব্য – সিন্দুর, পুরোহিত বরণ ১, তিল, হরিতকী, পঞ্চগুঁড়ি, পঞ্চগব্য, পঞ্চশস্য, পঞ্চরত্ন, পঞ্চপল্লব, ঘট ১, কুন্ডহাঁড়ি ১,তেকাঠা ১, দর্পণ ১, তীর ৪, ঘটচ্ছাদন গামছা ১, বরণডালা, সশীষ ডাব ১, একসরা আতপ তণ্ডুল, পুষ্প, দূর্ব্বা, তুলসী, বিল্ল্বপত্র, ধূপ, দীপ, ধুনা, বিশ্বকর্মার ধুতি ১, আসনাঙ্গুরীয়ক ১, মধুপর্কের বাটী, ঘৃত, দধি, মধু, নৈবেদ্য ১, কুচা নৈবেদ্য ১, চন্দ্রমালা ১, পুষ্পমালা ১, থালা ১, ঘটি ১, পান, পানের মশলা, বালি, কাষ্ঠ, খোড়কে, গব্যঘৃত ১ পোয়া, পূর্ণপাত্র ১, আরতি ও দক্ষিণা।

বিশ্বকর্মা পূজার ধ্যানমন্ত্র

ওঁ বিশ্বকর্মন্ মহাভাগ সুচিত্রকর্মকারক্ ।
বিশ্বকৃৎ বিশ্বধৃক্ ত্বঞ্চ রসনামানদণ্ডধৃক্ ।।

এর অর্থ হল, হে দংশপাল ( বর্মের দ্বারা পালনকারী ) , হে মহাবীর , হে বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ও বিশ্ব বিধাতা, হে সুন্দর চিত্র রূপ কর্মকারক , আপনি মাল্য চন্দন ধারন করে থাকেন ।

বিশ্বকর্মা প্রনাম মন্ত্র

দেবশিল্পি মহাভাগ দেবানাং কার্য্যসাধক । বিশ্বকর্মন্নমস্তুভ্যং সর্বাভীষ্টপ্রদয়ক ।।

অর্থ- দেবশিল্পী , মহাভাগ ( দয়াদি অষ্ট গুন যুক্ত ) দেবতা দের কারু কার্য্যসাধক সর্বাভীষ্ট প্রদানকারী হে বিশ্বকর্মা আপনাকে নমস্কার।

বিশ্বকর্মা পূজা পুষ্পাঞ্জলী মন্ত্র

দেবশিল্পী মহাভাগ দেবণাং বিধিবৎ কল্যাণং কুরু যে সদা আয়ুৰ্যশঃ বলং দেহি শিল্পে দেহি শুভাং মতি ধনং দেহি,যশো দেহি

বিশ্বকৰ্মণ প্রসীদ মে শিল্পচার্য্যং নমস্তুভ্যং নানালঙ্কার ভূষিতম্ মম বিঘ্নবিনাশায় কল্যাণং কুরু যে সদা

এষ সচন্দন পুষ্প বিল্বপত্রাঞ্জলি ওম বিশ্বকর্ণে নমঃ (তিনবার বলবেন)

বিশ্বকর্মা পূজা সংকল্প মন্ত্র

ওঁ বিষ্ণুরোম্ তৎসদদ্য ভদ্রেমাসি কৃষ্ণে পক্ষে অমাবস্যায়াং তিথেী অমুক গোত্রঃ (নিজের গোত্র )

বিশ্বকর্মা পূজা শান্তি মন্ত্র

ওঁম স্বতি নন্দ্রো বৃদ্ধশ্রবাঃ স্বতি নঃ পূষা বিশ্বেদাঃ স্বস্তিনতাক্ষো অরিষ্টনেমিঃ স্বতি ন বৃহস্পতির্ধাতু

ওম স্বস্তি, ওম স্বস্তি, ওম স্বস্তি ওঁম দৌঁ শান্তিঃ, শান্তিঃ অন্তরীক্ষ শান্তিঃ, বনস্পতয়ঃ শান্তিঃ ওষধয়ঃ শান্তিঃ, সর্বাপচ্ছন্তিঃ

রোগাদি শান্তি, গ্রহপীড়াদিঃ শান্তিঃ শান্তিরেব শান্তিঃ ওঁ ম শান্তিঃ, ওঁ শান্তিঃ, ওঁ শান্তিঃ

বিশ্বকর্মা পূজার পাঁচালী

রাবনের রাজাপ্রসাদের সাথে সুন্দর উদ্যান, গোষ্ঠ, মন্ত্রণা গৃহ, মনোরম ক্রীড়া স্থান, রাজাপ্রাসাদের কারুকার্য ইত্যাদি দেবশিল্পীর নিখুত শিল্প কলার পরিচয় দেয় । এছাড়া ভাগবত পুরান অনুসারে দ্বারকা নগরীর যে সুরক্ষিত, ভাস্কর্য , কলা কৌশলের একটি ধারনা পাওয়া যায়- তাতে শিল্পী বিশ্বকর্মার শিল্প কে দেখে আশ্চর্য হতে হয় । বিশ্বকর্মার অপর নির্মাণ হল দেবপুরী । তিনি সমস্ত সৌন্দর্য কে মিলিয়ে এই পুরী নির্মাণ করেছিলেন । এই পুরীকে পাওয়ার জন্য বারংবার অসুর গণ সুর লোকে হানা দিয়েছিলেন। তাই বিশ্বকর্মার সৃষ্টিকে প্রনাম না করে থাকা যায় না।


মৎস্য পুরান বলে- কি কূপ, কি প্রতিমা, কি গৃহ, কি উদ্যান সকল কিছুর উদ্ভাবক হলেন বিশ্বকর্মা। শুধু এখানেই বিশ্বকর্মার সৃষ্টি শেষ নয়, যে বিমানে চড়ে দেবতারা গমন করেন- তাও বিশ্বকর্মার তৈরী। এবং বিভিন্ন দিব্য বান- যা কেবল দেবতাদের অস্ত্রাগারে থাকে – তাও বিশ্বকর্মার তৈরী। যে ধনুক দিয়ে ভগবান শিব ত্রিপুরাসুরকে বধ করেছিলেন, যে ধনুক পরশুরামের কাঁধে শোভা পেতো- সেই ধনুক বিশ্বকর্মার সৃষ্টি। বৃত্রাসুর বধের জন্য বিশ্বকর্মা দধীচি মুনির অস্থি থেকে বজ্র নির্মাণ করে দেবেন্দ্র কে দিয়েছিলেন।

কিছু পুরান বলে ভগবান বিষ্ণুর চক্র, ভগবান শিবের ত্রিশূল বিশ্বকর্মার সৃষ্টি । শ্রী শ্রী চন্ডীতে দেখি মহিষাসুর বধের জন্য দেবী মহামায়া প্রকট হলে দেবীকে তীক্ষ্ণ বর্শা, অভেদ্য কবচ এবং বহু মারনাস্ত্র বিশ্বকর্মা দেবীকে প্রদান করেন । রামচন্দ্রের সেতু বন্ধনের অন্যতম কারিগর নল এই বিশ্বকর্মার পুত্র।


বিষ্ণু পুরান বলে ত্বষ্টা নামক এক শিল্পী ছিল- যিনি বিশ্বকর্মার পুত্র । দেবতাদের শিল্পী যেমন বিশ্বকর্মা , তেমনি অসুর দের শিল্পী হলেন ময় দানব । বায়ু পুরান ও পদ্ম পুরান মতে ভক্ত প্রহ্লাদের কন্যা বিরোচনার সাথে বিশ্বকর্মার বিবাহ হয় । বিশ্বকর্মার ঔরসে বিরোচোনার গর্ভে অসুর শিল্পী ময় দানবের জন্ম হয়।


ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরান মতে বিশ্বকর্মা ও তাঁর স্ত্রী ঘৃতাচী দুজনেই শাপ পেয়ে ধরাধামে জন্ম নেন । ঘৃতাচী ছিলেন স্বর্গের এক নর্তকী । তাঁদের নয়টি সন্তান হয় – যথা মালাকার , কর্মকার , কাংস্যকার, শঙ্খকার , সূত্রধর, কুবিন্দক, কুম্ভকার, স্বর্ণকার, চিত্রকর । বিশ্বকর্মা প্রত্যেক কেই নানান শিল্প শেখান।

তিনি মালাকারকে পুস্প শিল্প, কর্মকারকে লৌহ শিল্প, কাংস্যকারকে কাংস শিল্প, শঙ্খ কারকে শঙ্খ শিল্প, সূত্রধরকে কাষ্ঠ শিল্প, কুবিন্দক কে বয়ন শিল্প, কুম্ভকারকে মৃৎ শিল্প, স্বর্ণকারকে অলঙ্কার শিল্প, চিত্রকরকে অঙ্কন শিল্প শেখান। স্কন্ধ পুরান বলে বৃত্রাসুর হলেন বিশ্বকর্মার পুত্র। যাকে ইন্দ্র দেবতা বধ করেন । তবে স্কন্ধ পুরানের এই মত অপর কোন পুরানে পাওয়া যায় নি।


এত সর্তেও বলা যায় বিশ্বকর্মার এক মেয়ে পিতার অমতে বিয়ে করেছিল। এই কারনে বিশ্বকর্মা বানর হয়ে পৃথিবীতে জন্মান । ঘটনা টি এই- বিশ্বকর্মা ও ঘৃতাচীর কন্যা চিত্রাঙ্গদা পৃথিবীর সূর্য বংশীয় রাজা সুরথ কে ভালোবাসতো। সুরথও চিত্রঙ্গদা কে ভালোবাসতো।

কিন্তু দেবতা হয়ে ত মানুষের সাথে বিবাহ হয় না । বিশ্বকর্মা জানতে পেরে মেয়েকে যথেষ্ট শাসন করলেন । এই অবস্থায় পৃথিবীর মেয়েরা যা করে বিশ্বকর্মার কন্যা টিও তাই করলো । স্বর্গ থেকে পালালো । দুজনে বিবাহ করে নিলো। ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বিশ্বকর্মা আসলেন।

কন্যা ভাবলেন পিতা বুঝি আশীর্বাদ করতে এসেছেন । কিন্তু না। বিশ্বকর্মা অভিশাপ দিলেন । কন্যার বিবাহ বিচ্ছেদ হোক – এমন অভিশাপ দিলেন । কিন্তু সনাতন ধর্মে বিবাহকে খুব পবিত্র সম্পর্ক মানা হয়- যেখানে বিবাহ বিচ্ছদের স্থান নেই। 


তাই মহর্ষি ঋতধ্বজ ভাবলেন দেবতা হয়ে বিশ্বকর্মার একি পশুর মতো বুদ্ধি? মুনি বিশ্বকর্মা কে বানর কূলে জন্মাবার শাপ দিলেন । বিশ্বকর্মা বানর হলেন । অবশেষে এক সময় কন্যার বিবাহ মেনে নিলে কন্যা ও বিশ্বকর্মা দুজনেরই শাপ দূর হয়।

বিশ্বকর্মা পূজা পদ্ধতি, মন্ত্র, পূজার ফর্দ ও পূজার নিয়ম PDF : আশাকরি এই নিবন্ধ টি আপনার বিশ্বকর্মা পূজার কাজে যথেষ্ট সহায়তা করবে যদি পোষ্টটি ভালো লেগে থাকে তাহলে শেয়ার করতে ভুলবেন না আরও নতুন নতুন তথ্য পাওয়ার জন্যে আমাদের ওয়েবসাইট টি সাবস্ক্রাইব করতে পারেন নমস্কার।

Leave a Comment

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now