Bangla Sad Love Story in Bangla Font | বীণার অসুখ

WhatsApp Channel Follow Now
Telegram Group Follow Now

Last updated on July 4th, 2023 at 12:49 am

Rate this post
আজকে আমি আপনাদের সঙ্গে একটি Bangla Sad Love Story শেয়ার করছি, গল্পটির নাম “বীণার অসুখ” আশাকরি আপনারা সকলে গল্পটি মনোযোগ সহকারে পড়বেন এবং গল্পটি যদি শুনতে চান তাহলে পরে নীচে দেওয়া অডিও ফাইলে ক্লিক করে শুনতে পারেন। আরও Bengali Story এবং Shakchunnir Golpo পড়ার জন্য আমাদের ব্লগ টিকে Bookmark করে রাখতে পারেন। 

Bangla Sad Love Story in Bangla Font


A True Sad Love Story in Bengali Language



বীণার বয়স একুশ। সে লালমাটিয়া কলেজে বি.এ. সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ত। বীণার মামা ইদরিস সাহেব একদিন হঠাৎ বললেন, বীণা তোর কলেজে যাবার দরকার নেই। বাসায় থেকে পড়াশোনা কর। পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দিলেই হবে। কলেজে আজকাল কী পড়াশোনা হয় তা তো জানাই আছে। যাওয়া নাযাওয়া একই। বীণা ঘাড় নেড়ে ক্ষীণস্বরে বলল, জী আচ্ছা। মামার কথার ওপর কথা বলার সাহস বীণার নেই। তার পড়াশোনার যাবতীয় খরচ মামা দেন। 




গত বছর গলার একটা চেন বানিয়ে দিয়েছেন। তা ছাড়া তার বিয়ের কথা হচ্ছে। বিয়ে যদি ঠিক হয় সেই খরচও মামাকেই দিতে হবে। বীণার বাবা প্যারালাইসিস হয়ে দেশের বাড়িতে পড়ে আছেন। তাঁর পক্ষে একটা টাকাও খরচ করা সম্ভব না। তিনি সবার কাছ থেকে টাকা নেন। কাউকে কিছু দেননি। ইদরিস সাহেব বললেন, বীণা তুই আমাকে এক গ্লাস শরবত বানিয়ে দে। আর শোন, কলেজে না যাওয়া নিয়ে মন-টন খারাপ করিস না। মনখারাপের কিছু নেই। জী আচ্ছা মামা। বীণা শরবত আনতে চলে গেল। তার মনটা অসম্ভব খারাপ। 

কলেজ বন্ধ করে দেবার কোনো কারণ সে বুঝতে পারছে না। জিজ্ঞেস করার সাহসও নেই। দিনের পর দিন ঘরে বসে থেকেই-বা সে কী করবে? শরবত বানাতে বানাতে তার মনে হল— হয়তো তার বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গেছে। গফরগাঁয়ের ঐ ছেলে শেষ পর্যন্ত হয়তো রাজি হয়েছে। ওরাই হয়তো বলেছে— মেয়েকে কলেজে পাঠাবেন না। বিয়ে ঠিকঠাক হলে ছেলেপক্ষের লোকজন অদ্ভুত অদ্ভুত শর্ত দিয়ে দেয়। গফরগাঁয়ের ঐ ছেলেটাকে একেবারেই পছন্দ হয়নি। কেমন যেন পশুপশু চেহারা। 

আরও পড়ুনঃ

সোফায় বসেছিল দুই হাঁটুতে দুহাত রেখে। মুখ একটু হাঁ হয়েছিল। সেই হাঁ-করা মুখের ভেতর কালো কুচকুচে জিভ। বীণার দিকে এক পলক তাকাতেই বীণার বুক ধক করে উঠল। মনে হলো একটা পশু জিভ বের করে বসে আছে। তার নাকে ঝাঁঝালো গন্ধও এসে লাগল। গন্ধ ঐ লোকটার থেকে আসছিল। টক দুধ এবং পোড়া কাঠের গন্ধ একত্রে মেশালে যেরকম গন্ধ হয় সেরকম একটা গন্ধ। গা কেমন ঝিমঝিম করে। লোকটা তাকে কোনো প্রশ্ন করল না। শুধু পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইল। 

বীণার একবার মনে হলো, লোকটার চোখে হয়তো পাতা নেই। সাপের যেমন চোখের পাতা থাকে না সেরকম। লোকটার সঙ্গে বয়স্ক যে দুজন মানুষ এসেছিলেন তারা অনবরত কথা বলতে লাগলেন। একজন বীণাকে ডাকতে লাগলেন আন্টি। চুল-দাড়ি পাকা বয়স্ক একজন লোক যদি আন্টি ডাকে তখন ভয়ংকর রাগ লাগে। কোনো কথারই জবাব দিতে ইচ্ছা করে না। বীণা অবিশ্যি সব প্রশ্নের জবাব দিল কারণ মামা তার পাশেই বসে আছেন। মামা বসেছেন সোফার ডানদিকে— সে বাঁদিকে।




প্রশ্নের জবাব না দেয়ার কোনো উপায়ই নেই। তারপর আন্টি, রবি ঠাকুর কত সনে নোবেল পুরস্কার পান তা জানা আছে? জী না। উনিশশো তেরো। অবিশ্যি উনি উনিশশো তেরোতে না পেয়ে উনিশশো একত্রিশে পেলেও কিছু যেত আসত না। তবু তারিখটা জানা দরকার। এটা হচ্ছে জেনারেল নলেজ। মেয়েরা শুধু যে রান্নাবান্না করবে তা তো না— তাদের পৃথিবীতে কী হচ্ছে না-হচ্ছে তাও তো জানতে হবে। কী বলেন আন্টি? জী। আন্টি, আপনি খবরের কাগজ পড়েন? না। এইটা হচ্ছে মেয়েদের একটা কমন দোষ। 

কোনো মেয়ে খবরের কাগজ পড়ে না। আপনি কেন খবরের কাগজ পড়েন না, না-পড়ার কারণটা কী আমাদের একটু বলুন তো আন্টি! বীণা কিছু বলল না। মামা পাশে বসে আছেন এই ভয়েই বলল না। কারণ মামা খবরের কাগজ রাখেন না বলেই সে খবরের কাগজ পড়ে না। এই তথ্যটা এঁদের জানানো নিশ্চয়ই ঠিক হবে না। মামা রাগ করবেন। ইদরিস সাহেব বললেন, মা বীণা, ইনাদের চা মিষ্টি দাও। পাঁচ জাতের মিষ্টি টেবিলে সাজানো। 

বীণা প্লেটে উঠিয়ে উঠিয়ে সবার দিকে এগিয়ে দিল। লোকটাকে যখন দিতে গেল তখন লোকটা অদ্ভুত একধরনের শব্দ করল। থাবার মতো বিশাল হাত বাড়িয়ে মিষ্টির থালা নিল। বীণা লক্ষ করল লোকটির আঙুলের নখ কালচে ধরনের। নখের মাথা পাখির নখের মতো ছুঁচালো। বীণার গা সত্যি সত্যি কাঁটা দিয়ে উঠল। সে মনে-মনে বলল, আল্লাহ এই লোকটা যেন আমাকে পছন্দ না করে। আল্লাহ এই লোকটা যেন আমাকে পছন্দ না করে। 

লোকটা বীণাকে পছন্দ করল কি করল না কিছুই বোঝা গেল না। ইদরিস সাহেব এই প্রসঙ্গে বাসার কারোর সঙ্গেই কোনো আলাপ করলেন না। ইদরিস সাহেবের এই হলো স্বভাব। বাসার কারোর সঙ্গে কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলবেন না। নিজে যা ভালো বুঝবেন তা-ই করবেন। এই যে তিনি আজ বীণার কলেজে যাওয়া বন্ধ করলেন–এর কারণ তিনি কাউকে বলবেন না। ইদরিস সাহেবের জীবনের মূলমন্ত্র হচ্ছে নারীজাতির সঙ্গে কোনো বিষয় নিয়ে আলাপ না করা। 

নারীজাতির সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনার ফল একটাই সময় নষ্ট। কী দরকার সময় নষ্ট করার? ইদরিস সাহেবের বাসায় তিনি ছাড়া সবাই মেয়ে। সব মিলিয়ে সাতজন মেয়ে। ইদরিস সাহেবের স্ত্রী, চার কন্যা, তাঁর এক ছোট বোন এবং কাজের একটি মেয়ে। তাঁর বাসায় দুটি বিড়াল থাকে। এই বিড়াল দুটিও মেয়েবিড়াল। সঙ্গত কারণেই ইদরিস সাহেব বাসায় যতক্ষণ থাকেন মনমরা হয়ে থাকেন। চারদিকে মেয়েজাতি নিয়ে বাস করতে তার ভালো লাগে না। 




তিনি তাঁর ব্যবসা, তাঁর পরিকল্পনা কিছুই কাউকে বলেন না। দিন পনেরো বীণার খুব ভয়ে-ভয়ে কাটল। কে জানে হয়তো লোকটা তাকে পছন্দ করে ফেলেছে। তার চেহারা এমন কিছু খারাপ না, পছন্দ করতেও পারে। রং মোটামুটি ফরসা। চোখ দুটো মায়া-মায়া, লম্বা হালকাপাতলা শরীর। সাজলে তাকে ভালোই দেখায়। পছন্দ করে ফেললে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। বীণা বেশ কয়েকবার লজ্জার মাথা খেয়ে তার মামিকে জিজ্ঞেস করেছে, মামি, মামা কি কিছু বলেছে? 

বীণার মামি হাসিনা পৃথিবীর সরলতম মহিলা। অতি সহজ কথাও তিনি বোঝেন না। একটু ঘুরিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে এমনভাবে তাকান যে মনে হয় অথৈ জলে পড়েছেন। বীণার সহজ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন— কিসের কথা রে? ঐ যে শুক্রবারে যে আসল? কে আসল শুক্রবারে? তিনজন লোক আসল না? তিনজন লোক আবার কখন আসল? বিয়ের আলাপ নিয়ে আসল না? ও আচ্ছা—মনে পড়েছে। না, কিছু বলে নাই। তোর মামা কি কখনো কিছু বলে? 

হঠাৎ একদিন শুনবি বিয়ের দিন-তারিখ হয়ে গেছে। তোর মামা আগেভাগে কিছু বলবে? কোনোদিন না। মাসখানিক কেটে যাবার পরেও বীণার ভয় কাটল না। মামা তাকে কোনো কারণে ডাকলেই মনে হতো এই বুঝি বলবেন, বীণা তোর বিয়ের তারিখ ঠিক করে ফেললাম। শ্রাবণ মাসের বার, মঙ্গলবার। তুই তোর বাবাকে চিঠি লিখে দে।

বীণা আতঙ্কে আতঙ্কেই ভয়াবহ কিছু দুঃস্বপ্নও দেখল। এই দুঃস্বপ্নগুলির প্রতিটিতে তার বিয়ে হয় সুন্দর একটা ছেলের সঙ্গে। বাসরঘরে সে আর ছেলেটা থাকে, আর সবাই চলে যায়। লজ্জায় সে মাথা নিচু করে থাকে। তখন তার স্বামী আদুরে গলায় বলে— লজ্জায় দেখি মরে যাচ্ছ! এই, তাকাও-না আমার দিকে। তাকাও। সে তাকায়। তাকাতেই তার গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায়। 

মানুষ কোথায়, একটা কুকুরের মতো পশু থাবা গেড়ে বসে আছে। হাঁ-করা মুখের ভেতর কুচকুচে কালো একটা জিহ্বা। জিহ্বা মাঝে মাঝে মুখের ভেতর থেকে বের হয়ে আসছে। পশুটার নখ ছুঁচালো। তার গা থেকে টক দুধ আর পোড়া কাঠের গন্ধ ভেসে আসছে। স্বপ্নে মানুষ গন্ধ পায় না। কিন্তু বীণা এইজাতীয় স্বপ্নে গন্ধ পেত। তীব্র কটু গন্ধেই একসময় ঘুম ভেঙে যেত। প্রায় দেড়মাস এরকম আতঙ্কে কাটল। 

তারপর আতঙ্ক হঠাৎ করেই কেটে গেল। কারণ ইদরিস সাহেব এক ছুটির দিনের দুপুরে ভাত খেতে খেতে বললেন, বিয়েটা ভেঙে দিলাম। হাসিনা বললেন, কার বিয়ে ভেঙে দিলে? বীণার। ঐ যে তিনজন এসেছিল শুক্রবারে। খুব চাপাচাপি করছিল। মেয়ে নাকি তাদের খুব পছন্দ। ওদের বাড়ির অবস্থা ভালো। গফরগাঁয়ে কাপড়ের ব্যবসা আছে। গ্রামের বাড়িতে ধান ভাঙার কল দিয়েছে। বড় বড় আত্মীয়-স্বজন। তাহলে বিয়ে ভেঙে দিলে কেন? ছেলের গায়ে বিশ্রী গন্ধ। 




ঘোড়ার আস্তাবলে গেলে যেমন গন্ধ পাওয়া যায় সেইরকম। যে-কবার এই ছেলে আমার কাছে এসেছে এরকম গন্ধ পেয়েছি। কী দরকার? হাসিনা দুঃখিত মুখ করে বললেন, আহা গন্ধের জন্যে বিয়েটা বাতিল করে দিলে! ভালোমতো সাবান দিয়ে গোসল দিলেই তো গন্ধ চলে যায়। ইদরিস কড়া গলায় বললেন, যা বোঝ না তা নিয়ে কথা বলবে না। তুমি রোজ গিয়ে গোসল করিয়ে আসবে নাকি?

মেয়েছেলে মেয়েছেলের মতো থাকবে। সবকিছুর মধ্যে কথা বলবে না। রাগ করছ কেন? রাগ করার মতো কী বললাম? চুপ। আর একটা কথাও না। ইদরিস সাহেবের দুর্ব্যবহারে হাসিনা কাঁদতে বসেন, তবে বীণার আনন্দের সীমা থাকে না। যাক শেষ পর্যন্ত লোকটির সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে না। মামার প্রতি কৃতজ্ঞতায় বীণার মন ভরে যায়। মামা কথা না বললেও মানুষ খারাপ না। কে জানে এই যে তাকে কলেজে যেতে নিষেধ করেছেন এরও কোনো ভালো দিক নিশ্চয়ই আছে। 

মামা যদি শুধু কারণটা বলতেন। কিন্তু মামা বলবেন না। অদ্ভুত মানুষ। নিতান্তই আকস্মিকভাবে বীণা তার কলেজ বন্ধ হবার রহস্য জেনে ফেলল। ইদরিস সাহেব বীণার বাবাকে চিঠিতে কারণটা জানিয়েছেন। খামে ভরার আগে এই চিঠি বীণা পড়ে ফেলল। পাকজনাবেষু দুলাভাই, আমার সালাম জানিবেন। পর সমাচার এই যে, বীণার কলেজ যাওয়া একটি বিশেষ কারণে বন্ধ করিতে হইয়াছে। বীণা ইহাতে কিঞ্চিৎ মনে কষ্ট পাইয়াছে।

কিন্তু ইহা ছাড়া অন্য উপায় দেখিলাম না। এখন আপনাকে কারণ বলিতেছি। জোবেদ আলি নামক গফরগাঁয়ের জনৈক যুবকের সহিত বীণার বিবাহের আলাপ হইয়াছিল। পাত্রপক্ষের, বিশেষ করিয়া পাত্রের বীণাকে খুবই পছন্দ হইয়াছিল। একটি বিশেষ কারণে বিবাহের প্রস্তাব বাতিল করিয়া দিতে হইয়াছে। এখন কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়াছে। উক্ত জোবেদ আলি প্রায়শই বীণাকে অনুসরণ করিয়া কলেজ পর্যন্ত যায়। ইহা আমার কাছে অত্যন্ত সন্দেহজনক বলিয়া মনে হইল। 

আজকালকার ছেলেদের মতিগতির কোনো ঠিক নাই। একবার যদি অ্যাসিড়জাতীয় কিছু দেয় তাহা হইলে সর্বনাশের কোনো শেষ থাকিবে না। যাহা হউক আপনি তাহার বি.এ. পরীক্ষা নিয়া কোনো চিন্তা করিবেন না। আমি কলেজে প্রিন্সিপালের সহিত আলাপ করিয়াছি। তিনিও বলিয়াছেন কোনো অসুবিধা হইবে না। আগেকার মতো কলেজগুলি পার্সেন্টেজ নিয়া ঝামেলা করে না। আপনার শরীরের হাল-অবস্থা এখন কী? 

শরীরের যত্ন নিবেন। বীণাকে লইয়া অযথা চিন্তাগ্রস্ত হইবেন না। চিঠি পড়ে বীণার গা কাঁপতে লাগল। কী সর্বনাশের কথা, ঐ লোক তার পেছনে পেছনে যায়। কই সে তো একদিনও টের পায়নি! আর তার মামার কি উচিত ছিল না ঘটনাটা তাকে জানানো? সে এখন কলেজে যাচ্ছে না। ঠিকই কিন্তু অন্য জায়গায় তো যাচ্ছে। আগে জানলে তাও যেত না। ঘরে বসে থাকত। অবশ্যই মামার উচিত ছিল ঘটনাটা তাকে জানানো। 

বীণাকে খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে বলা ঠিক হবে না। সে যদি বুদ্ধিমতী মেয়ে হতো তাহলে চট করে বুঝে ফেলত তাকে ঘটনাটা জানানোর জন্যেই ইদরিস সাহেব খামে ভরার আগে চিঠিটা দীর্ঘ সময় টেবিলে ফেলে রেখেছিলেন। এইজাতীয় ভুল তিনি কখনো করেন না। বীণা বাড়ি থেকে বের হওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দিল। আগের ভয়ের স্বপ্নগুলি আবার দেখতে লাগল। এবারের স্বপ্নে আরো সব কুৎসিত ব্যাপার ঘটতে লাগল। 




এমন হলো যে, ঘুমুতে পর্যন্ত ভয় লাগে। হাসিনা বলেন, কী হয়েছে তোর বল তো? বীণা ফ্যাকাশে হাসি হেসে বলে, কই কিছু হয়নি তো? তুই তো শুকিয়ে চটিজুতা হয়ে যাচ্ছিস! তোর তো আর বিয়েই হবে। এরকম শুকনো মেয়েকে কে বিয়ে করবে বল? গায়ে গোশত না থাকলে ছেলেরা মেয়েদের পছন্দ করে না। ছেলেগুলি হচ্ছে বদের বদ। ঝটা মার এদের মুখে। 

বীণার বন্দিজীবন কাটতে লাগল। মেয়েরা যে-কোনো পরিস্থিতিতে নিজেদের খুব সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। বীণাও খাপ খাইয়ে নিল। সারাদিন তিন কামরার ঘরেই সময় কাটে। বাইরের বারান্দায় ভুলেও যায় না। বাইরের বারান্দায় দাঁড়ালে রাস্তার অনেকটা চোখে পড়ে। তার ভয় বারান্দায় দাঁড়ালে যদি লোকটাকে দেখে ফেলে। এত সাবধানতার পরেও একদিন দেখা হয়ে গেল।

বারান্দায় কাপড় শুকাতে দেয়া হয়েছে। হাসিনা বললেন, বৃষ্টি এসেছে, কাপড়গুলি নিয়ে আয় তত বীণা। বীণা কাপড় আনতে গিয়ে পাথরের মতো জমে গেল। বাড়ির সামনের রাস্তাটার অপর পাশে জারুল গাছের নিচে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে আছে বীণার দিকে। মুখ হাঁ হয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে খানিকটা কুঁজো হয়ে। বীণাকে দেখেই সে দ্রুত রাস্তা পার হয়ে এ-পাশে চলে এল। হাত-ইশারা করে কী যেন বলল। 

বীণা চিৎকার করে ঘরে ঢুকল। ঘণ্টাখানিকের মধ্যে তার জ্বর উঠে গেল একশো তিন। হাসিনা বললেন, এটা কেমন কথা! লোকটা তো বাঘও না ভালুকও। তাকে দেখে এত ভয় পাওয়ার কী আছে? বীণা বিড়বিড় করে বলল, আমি জানি না মামি। কেন এত ভয় লাগছে আমি জানি না। আপনি আমাকে ধরে বসে থাকেন। কেমন যেন লাগছে মামি। ইদরিস সাহেব সন্ধ্যাবেলা ঘরে ফিরে সব শুনলেন। 

কাউকে কিছুই বললেন না। সহজ ভঙ্গিতে খাওয়াদাওয়া করলেন। বড় মেয়েকে অংক দেখিয়ে দিলেন। রাত সাড়ে নটার সময় বললেন, একটা সুটকেসে বীণার কাপড় গুছিয়ে দাও তো! রাত এগারোটায় বাহাদুরাবাদ এক্সপ্রেস। বীণাকে দেশের বাড়িতে রেখে আসি। হাসিনা হতভম্ভ হয়ে বললেন, আজ রাতে? ইদরিস সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, আজ রাতে নয় তো কি পরশু রাতে নাকি? 

জোবেদ হারামজাদা বড় বিরক্ত করছে। আমি আরো কয়েকদিন দেখেছি। আজ রাতে যাওয়ার দরকার কী, কাল যাও। কাল যেতে পারলে আজ যেতে অসুবিধা কী? তোমরা মেয়েমানুষরা যা বোঝ না শুধু সেটা নিয়ে কথা বল। কাপড় গুছিয়ে দিতে বলেছি গুছিয়ে দাও। বীণার জ্বর। জ্বরের সঙ্গে কাপড় গোছানোর সম্পর্ক কী? কাপড় তো তুমি গোছাবে। তোমার গায়ে তো জ্বর নেই। 

হাসিনা কাপড় গুছিয়ে দিলেন। তাঁর স্বামীকে তিনি চেনেন। কথাবার্তা বলে লাভ হবে না। বীণা একশো দুই পয়েন্ট পাঁচ জ্বর নিয়ে বাহাদুরাবাদ এক্সপ্রেসে উঠল। বাড়িতে পৌঁছাতে সেই জ্বর বেড়ে গেল একশো চার পয়েন্ট পাঁচ। ইদরিস সাহেব ছুটি নিয়ে যাননি। বীণাকে রেখে পরদিনই তাঁকে চলে আসতে হলো। বীণা সপ্তাহখানিক জ্বরে ভুগে কংকালের মতো হয়ে গেল। মুখে রুচি নেই। যা খায় তা-ই বমি করে ফেলে দেয়। রাতে ঘুম হয় না। 

প্রায় রাতই জেগে জেগে কাটিয়ে দেয়। চোখের পাতা এক হলেই ভয়ংকর সব স্বপ্ন দেখে। এই সময় তার ভয়ের অসুখ হয়। সারাক্ষণই ভয় লাগে। কোনো কারণ ছাড়াই অস্বাভাবিক ভয়। কেউ হয়তো সামনে দিয়ে গেল অমনি বীণার বুক ধড়াস করে ওঠে। বাতাসে জানালার পাট নড়ে উঠলে বীণার হৃৎপিণ্ড লাফাতে শুরু করে, সে আতঙ্কে অস্থির হয়ে যায়। প্রচণ্ড ঘাম হয়। 




বীণাদের এই বসতবাড়িটা খুবই পুরনো। বীণার দাদা এক হিন্দু ব্যবসায়ীর কাছ থেকে খুব সস্তায় এই বাড়ি কিনে নিয়েছিলেন। অনেকখানি জায়গা নিয়ে বাড়ি। পুরো জায়গাটা দেয়াল দিয়ে ঘেরা। সংস্কারের অভাবে দেয়াল জায়গায় জায়গায় ভেঙে পড়েছে। দোতলার ঘরের বেশির ভাগই ব্যবহারের উপযোগী নয়। একতলার তিনটা ঘর শুধু ব্যবহার হয়। দোতলার ঘর তালাবদ্ধ থাকে। একটা ঘরে বীণার বাবা এমদাদ সাহেব থাকেন।

প্যারালাইসিসের কারণে এই ঘর থেকে বের হবার তাঁর কোনো উপায় নেই। অন্য একটা ঘরে বীণা এবং বীণার দূর-সম্পর্কের মামি মরিয়ম থাকেন। ঘরের কাজকর্ম করার জন্যে বাতাসী নামের কমবয়েসী একটা মেয়ে থাকে। তার চোখের অসুখ আছে। রাতে সে কিছুই দেখে না। বাড়িতে মানুষ বলতে এই চারটি প্রাণী। সন্ধ্যার পর থেকেই বীণার ভয়-ভয় করে। দোতলার বারান্দায় কিসের যেন শব্দ হয়। মনে হয় খড়ম পরে কেউ যেন হাঁটে। 

বীণা জানে ইঁদুর শব্দ করছে। তবু তার ভয় কাটে না। দুর্বল নার্ভের কারণেই হয়তো আতঙ্কে তার শরীর কাঁপতে থাকে। সে ফিসফিস করে বলে—কিসের শব্দ মামি? মামি ঘরের কাজ করতে করতে নির্বিকার গলায় বলেন, জানি না। মনে হয় ইঁদুরের শব্দ, তা-ই না মামি? হইতেও পারে। আবার অন্যকিছুও হইতে পারে। অন্যকিছু কী? সইন্ধ্যাবেলায় এরার নাম নেওন নাই মা। 

খারাপ বাতাস হইতে পারে। খারাপ বাতাস? কতদিনের পুরনো বাড়ি। উপরের ঘরগুলান খালি পইড়া থাকে। কেউ বাত্তি দেয়া না। ঘরে বাত্তি না দিলে খারাপ বাতাসের আনাগোনা হয়। বাতি দেন না কেন? বাতি দিলেই তো হয়। কাল থেকে রোজ সন্ধ্যায় বাতি দেবেন মামি। আচ্ছা দিমুনে। অখন ঘুমাও। বীণা শুয়ে থাকে। ঘুম আসে না। রাত যতই বাড়তে থাকে দোতলার শব্দ ততই বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় বীণার বাবার গোঙানি। 

গভীর রাতে তিনি হাঁটুর ব্যথায় গোঙ্গানির মতো শব্দ করেন। সেই শব্দ বীণার কানে অমানুষিক শব্দ বলে মনে হয়। যেন বীণার বাবা নয়, অন্য কেউ শব্দ করছে। সেই অন্য কেউ মানুষগোত্রীয় নয়। একধরনের চাপা হাসিও শোনা যায়। বীণাদের স্নানঘর মূল ঘর থেকে অনেকটা দূরে। স্নানঘর বীণার খুব প্রিয়। শ্যাওলা-ধরা। দেয়ালঘেরা ছোট্ট চারকোণা একটা জায়গা। ভেতরে চৌবাচ্চা আছে। স্নানঘরের ছাদটা ছিল টিনের। 

গত আশ্বিন মাসের ঝড়ে টিনের ছাদ উড়ে গেছে। সেই ছাদ আর ঠিক করা হয়নি। গোসলের সময় মাথার উপর থাকে খোলা আকাশ। ঠিক দুপুরবেলায় সূর্যের ছায়া পড়ে চৌবাচ্চার পানিতে। মগ ডােবালেই চৌবাচ্চা থেকে আলো ঠিকরে পড়ে চারদিকের সবুজ দেয়ালে। বীণার বড় ভালো লাগে। দুপুরবেলা বীণার অনেকখানি সময় এই গোসলখানায় কেটে যায়। 

রোজই মনে হয় গ্রামের বাড়িতে এসে ভালোই হয়েছে। রাতের তীব্র আতঙ্কের কথা তখন আর মনে থাকে না। এক দুপুরবেলায় এই গোসলখানাতেই অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার ঘটল। বীণা গোসল করছে। চারদিকে সুনসান নীরবতা। ঘন নীল আকাশের ছায়া পড়েছে চৌবাচ্চায়। বীণার চমৎকার লাগছে। শরীরটা আগের মতো দুর্বল লাগছে না। সে আপনমনে খানিকক্ষণ গুনগুন করল। বীণা মাথায় পানি ঢালল। ঠাণ্ডা পানি। 




শরীর কেঁপে উঠল। আর তখনই সে অদ্ভুত একটা গন্ধ পেল। অদ্ভুত হলেও গন্ধ চেনা, এই গন্ধ সে আগেও পেয়েছে। বীণা আতঙ্কে অভিভূত হয়ে পড়ল। নির্জন গোসলখানায় এই গন্ধ এল কোত্থেকে? গুঁড়া কাঠকয়লার সঙ্গে মেশানো নষ্ট দুধের মিশ্র গন্ধ। বীণা মগ ছুড়ে ফেলে গোসলখানার দরজায় আছড়ে পড়ল। দরজা খুলে দৌড়ে পালিয়ে যেতে হবে। আর এক মুহূর্ত এখানে থাকা যাবে না।

এক মুহূর্তও না। আশ্চর্যের ব্যাপার! বীণা দরজা খুলতে পারল না। ছিটকিনি নামানো হয়েছে। বীণা প্রাণপণে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে অথচ দরজা একচুলও নড়ছে না। যেন কেউ তাকে আটকে ফেলেছে। বীণা চিৎকার করবার চেষ্ট করল, গলা দিয়ে শব্দ বেরুল না। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দরজায় ধাক্কা দিল। দরজা তো নড়লই না, কোনো শব্দ পর্যন্ত হলো না। অথচ ঘরে অন্য একরকম শব্দ হচ্ছে। যেন কী-একটা পড়ছে চৌবাচ্চায়। 

টুপটাপ শব্দ। বৃষ্টির ফোঁটার মতো। কী পড়ছে? কিসের শব্দ হচ্ছে? বীণা হতভম্ব হয়ে দেখল টকটকে লালবর্ণের রক্ত পড়ছে চৌবাচ্চায়। চৌবাচ্চার পানি ক্রমেই ঘোলা হয়ে উঠছে। কেউ-একজন খোলা ছাদে বসে আছে। রক্ত পড়ছে তার পা থেকে। বীণা সেই দৃশ্য দেখতে চায় না। সে কিছুতেই উপরের দিকে তাকাবে। সে জানে উপরের দিকে তাকালেই ভয়ংকর কিছু দেখবে। এমন ভয়ংকর কিছু যা ব্যাখ্যার অতীত, অভিজ্ঞতার অতীত। কে যেন একজন খোলা ছাদে বসে আছে।

রক্ত পড়ছে তার পা থেকে। ভারী, জেড়িত স্বরে ডাকল— বীণা, ও বীণা। শব্দ উপর থেকে আসছে। কেউ একজন বসে আছে গোসলখানার দেয়ালে। যে বসে আছে তাকে বীণা চেনে। না-দেখেও বীণা বলতে পারছে কে বসে আছে। ও বীণা। বীণা। বীণা তাকাল। হ্যাঁ, ঐ লোকটিই বসে আছে। তবে লোকটির মুখ পশুর মতো নয়। মায়ামাখা একটি মুখ। বড় বড় চোখ দুটি বিষগ্ন ও কালো। লোকটি পা ঝুলিয়ে বসে আছে। 

পা দুটি অস্বাভাবিক–থ্যাঁতলানো। চাপচাপ রক্ত সেই থ্যাঁতলানো পা বেয়ে চৌবাচ্চার জলে পড়ছে। লোকটি ভারী শ্লেম্মাজড়িত স্বরে ডাকল–বীণা, ও বীণা। বীণা জ্ঞান হারাল। তার জ্ঞান ফিরল তৃতীয় দিনে জামালপুর সদর হাসপাতালে। চোখ মেলে দেখল আরো অনেকের সঙ্গে বিছানার পাশে ইদরিস সাহেব বসে আছেন। তাঁকে টেলিগ্রাম করে আনানো হয়েছে। ইদরিস সাহেব গভীর মমতার সঙ্গে বললেন, কী হয়েছে রে মা? 

বীণা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ভয় পেয়েছি মামা। ইদরিস সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, ভয় পাবারই কথা। ঐ জংলা বাড়িতে আমি নিজেই ভয় পাই আর তুই পাবি না? এখানে থাকার দরকার নেই, চল আমার সঙ্গে ঢাকায়। ঢাকায় গিয়ে আবার কলেজে যাওয়া-আসা শুরু কর। ঐ ছেলে আর তোকে বিরক্ত করবে না। বেচারা ট্রাক অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে। বীণা চোখ বন্ধ করে ফেলল। ইদরিস সাহেব নিজের মনেই বললেন, পায়ের উপর দিয়ে ট্রাক চলে গেছিল। দুটা পা-ই ছাতু হয়ে গেছে।

হাসপাতালে নেয়ার আঠারো ঘণ্টা পরে মারা গেছে। খবর পেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম। না গেলে অভদ্রতা হয়। ইদরিস সাহেব খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ছেলেটা খারাপ ছিল না, বুঝলি। খামোখাই আজেবাজে সন্দেহ করেছি। অতি দ্র ছেলে। তোর কথা জিজ্ঞেস করল। বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করল। বীণার ইচ্ছা করল বলতে আমার কথা কি জিজ্ঞেস করল মামা? 

সে বলতে পারল না। ইদরিস সাহেব বললেন, ছেলেটার অ্যাকসিডেন্টের খবর তার অঞ্চলে পৌঁছামাত্র সেখানের সব লোক এসে উপস্থিত। হাজার হাজার মানুষ। হাউমাউ করে কাঁদছে। দেখবার মতো একটা দৃশ্য! বুঝলি বীণা, আমরা মানুষের বাইরেরটাই শুধু দেখি। অন্তর দেখি না। এটা খুবই আফসোসের ব্যাপার। তোর যাতে ভালো বিয়ে হয় এইজন্যে আমাকে কিছু টাকাও দিয়ে গেছে। না করতে পারলাম না। একটা মানুষ মারা যাচ্ছে কী করে না বলি! ঠিক না?

Bangla Sad Love Story অর্থাৎ কষ্টের গল্পটি পরে কেমন লাগলো মন্তব্য করে জানাবেন যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করতে ভুলবেন না।

Leave a Comment

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now