সরস্বতী পূজার উপকরণ, দশকর্মা ও ফর্দমালা

Rate this post
WhatsApp Channel Follow Now
Telegram Group Follow Now

রাত পোহালেই বিদ্যার দেবী মা সরস্বতীর পূজা। আপনার প্রয়োজনীয় সরস্বতী পূজার উপকরণ, দশকর্মা ও ফর্দমালা গুলো সম্পর্কে সঠিক তথ্য পেয়ে যাবেন আমাদের আজকের এই নিবন্ধে।

সরস্বতী পূজার উপকরণ

সরস্বতী পূজা হলো বাঙালিদের তথা আপামর ভারতবাসীর প্রাণের উৎসব। বিদ্যার দেবীকে ঘিরে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। বাঙালিদের বিশ্বাস অনুযায়ী সারা বছরজুড়ে দেবী সরস্বতী আমাদের মধ্যে জ্ঞান এবং সংস্কৃতিচর্চার রসদ জুগিয়ে দেন। ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক- অভিভাবিকা ও সাধারণ মানুষ সকলেই দেবী সরস্বতীর আরাধনা করেন। দেবী সরস্বতী শুধুই বিদ্যার দেবী নন, তিনি সঙ্গীতের ও ললিতকলার দেবীও। তাইতো শিল্পী মাত্রেই মায়ের পূজা করে থাকে।

সরস্বতী পূজার উপকরণ

সিদ্ধি, সিন্দূর, পুরোহিতবরণ ১, তিল, হরিতকী, পঞ্চগুঁড়ি, পঞ্চশস্য, পঞ্চরত্ন, পঞ্চপল্লব ১, ঘট ১, কুন্ডহাঁড়ি ১, তেকাঠা ১, দর্পণ ১, তীরকাঠি ৪, ঘটাচ্ছাদন গামছা ১, বরণডালা, সশীষ ডাব ১, একসরা আতপচাউল, পুষ্পাবি, আসনাঙ্গুরীয়ক ২, মধুপর্কের বাটী ২, নৈবেদ্য ২, কুচা নৈবেদ্য ১, সরস্বতীর শাটী ১, লক্ষীর শাটী ১, চন্দ্রমালা ১, বিল্বপত্রমাল্য ১, থালা ১, ঘটি ১, শঙ্খ ১, লৌহ ১, নথ ১, রচনা, আমের মুকুল, যবের শীষ, কুল, আবির, অভ্র, মস্যাধার(দোয়াত) ও লেখনী, ভোগের দ্রব্যাদি, বালি, কাষ্ঠ, খোড়কে, গব্যঘৃত এক সের, পান, পানের মশলা, হোমের বিল্বপত্র ২৮, কর্পূর, পূর্ণপাত্র ১, দক্ষিণা।

সরস্বতী পূজার ফর্দমালা

বিদ্যারম্ভের উপকরণ বা হাতেখড়ির ফর্দ

বিষ্ণু পূজার ধুতি ১, লক্ষী ও সরস্বতী পূজার শাড়ি ২, বালকের পরিধেয় বস্ত্র ১, মধুপর্কের কাংস্য বাটী ৩, আসন ৩, রূপার অঙ্গুরীয়ক ৩, দধি, মধু, তিল, হরিতকী, ফল-মুলাদি, সিন্দুর, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য ৩, কুচা নৈবেদ্য ১, ফল, স্লেট, রাম খড়ি ১, বর্ণমালা পুস্তক ১ খনি, তুলসী, বিল্বপত্র, দূর্ব্বা ও পুষ্পাদি, দক্ষিণা।

জয় জয় দেবী চরাচর সারে
কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে
বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে
ভগবতী ভারতী দেবী নমস্তুতে।

পংক্তিগুলো হয়তো সবার জানা আছে। প্রতি বছর সরস্বতী পূজার দিন এই মন্ত্র উচ্চারিত হয় সকলের মুখেই। এতে রয়েছে দেবীর রূপের বর্ণনা। দেবী সরস্বতী সর্বশুক্লা। তাঁর বসন ও গায়ের রং শুভ্র। তিনি পদ্মের উপর আসীন, তবে সেই পদ্মও শ্বেত পদ্ম। তাঁর বাহন হংস, তাও শ্বেত রঙের। তাছাড়া দেবীর একটি হস্তে থাকে পুস্তক এবং অন্য হস্তে একটি বীণা থাকে।

প্রাচীন হিন্দু সাহিত্যে সরস্বতী বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন, ব্রহ্মাণী (ব্রহ্মার শক্তি), ব্রাহ্মী (বিজ্ঞানের দেবী), ভারতী (ইতিহাসের দেবী), বর্ণেশ্বরী (অক্ষরের দেবী), কবিজিহ্বাগ্রবাসিনী (যিনি কবিগণের জিহ্বাগ্রে বাস করেন) ইত্যাদি নাম। আবার সরস্বতী বিদ্যাদাত্রী (যিনি বিদ্যা দান করেন), বীণাবাদিনী (যিনি বীণা বাজান), পুস্তকধারিণী (যিনি হস্তে পুস্তক ধারণ করেন), বীণাপাণি (যাঁর হাতে বীণা শোভা পায়), হংসবাহিনী (যে দেবীর বাহন রাজহংস) ও বাগ্দেবী (বাক্যের দেবী) নামেও পরিচিত। শাস্ত্রীয় নির্দেশ অনুসারে মা সরস্বতী বৈদিক যুগের পরবর্তী একজন দেবী।

প্রাচীন যুগে তান্ত্রিকরা দেবী সরস্বতীর বদলে দেবী বাগেশ্বরীর আরাধনা করতেন। ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে দেবী সরস্বতীর বর্তমান রূপটি তুলনামূলকভাবে নতুন। তবে পুরাকালে পূজিত দেবীর রূপটি বর্তমানের তুলনায় ভিন্ন হলেও দুই রূপের মধ্যে খুব একটা তফাৎ ছিল না। বর্তমানে সরস্বতী পূজা বাঙ্গালীদের মধ্যে গৃহস্থের অন্দরমহল কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অঙ্গনে সীমাবদ্ধ। তবে কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষার সাথে যুক্ত নয় এমন প্রতিষ্ঠানগুলোতেই এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়।

এই পূজা সম্পর্কে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে কয়েক শতাব্দী আগে পর্যন্তও বাংলার বুকে বিভিন্ন জায়গায় ধুমধাম করে মহাসমারোহে সরস্বতী পূজা হত। এই প্রসঙ্গে বর্ধমানের রাজার তত্ত্বাবধানে প্রচলিত থাকা বিখ্যাত সরস্বতী পূজার কথার উল্লেখও বিশেষভাবে করতে হয়। সমগ্র বাংলা সহ বাংলার বাইরে থেকেও এই পূজার সাথে জড়িত অনুষ্ঠান দর্শনের উদ্দেশ্যে জনসমাগম হত।

বাগদেবী, ব্রাহ্মী, সারদা, ইলা, শতরূপা, মহাশ্বেতা, বীণাপাণি, বীণাবাদিনী, ভারতী, পৃথুধর, পদ্মাসনা, হংসারূঢ়া, হংসবাহনা, বকেশ্বরী সহ আরো অনেক নামেই দেবী ভক্তের হৃদয়ে বিরাজমান। মাঘ মাসের শুক্ল পক্ষের পঞ্চমী তিথিতে দেবী সরস্বতীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। সেজন্য এই পূজার তিথি শ্রীপঞ্চমী নামেও পরিচিত। শীতের শেষ ও বসন্তের প্রারম্ভে হয় দেবীর আরাধনা। এই সময়টি খুবই মনোমুগ্ধকর। দেবী সরস্বতীর পূজাকে ঘিরে ছাত্র-ছাত্রীদের মনে খুবই উৎসাহ ও উদ্দীপনা সঞ্চার হয়।

পূজা একদিনই হয় বটে কিন্তু পূজার এক- দু দিন আগে থেকে প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। পুজোর কয়েকদিন আগে কয়েকজন ছাত্ররা প্রতি শ্রেণীকক্ষে গিয়ে চাঁদা আদায় করে। এভাবে সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়, কারণ এই চাঁদা রূপে সংগ্রহ করা টাকা দিয়েই পুজো সম্পন্ন হয়। বিদ্যালয়ের সকলেই পুজোর কোনো না কোনো কাজে যুক্ত থাকে। পুজোর আগের দিন ছাত্র- ছাত্রীরা নিরামিষ ভোজন করে এবং নিজের মনকে পবিত্র রাখে, বছর বছর ধরে এভাবেই হয়ে আসছে।

এদিন সন্ধ্যাবেলা সকল ছাত্রছাত্রী মিলে প্রদীপ বা মোমবাতি নিয়ে শোভাযাত্রার মাধ্যমে মূর্তি নিয়ে আসে পুজো মন্ডপে। পূজার দিন খুব সকালে উঠে স্নান করে নতুন অথবা পরিষ্কার ধোয়া জামা কাপড় পরে ফুল তুলে সকল ছাত্রছাত্রী তথা শিক্ষকগণ পূজা মণ্ডপে উপস্থিত হয়। সেদিন সকাল থেকে অঞ্জলি না দেওয়া পর্যন্ত সকলেই উপবাসে থাকে। সকলে শুদ্ধ মনে পূজা শেষ করে,

সরস্বতী পূজা বিশেষত বাঙালিদের প্রধান উৎসবের একটি। এই পূজাকে কেন্দ্র করে বাঙালিদের মনে সর্বপ্রকার ভেদাভেদ ভুলে পূর্ণতার বিকাশ ঘটে। যুগ যুগ ধরে এই পূজা বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ রূপে বাঙালিদের বিশেষ পার্বণের তালিকাকে অলংকৃত করে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও এই ধারা একইভাবে অক্ষুণ্ণ থাকবে।

Leave a Comment

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now