Bangla Love Story online Reading | বাংলা লাভ স্টোরি

আজকের bangla love story টির নাম - "কুয়াশায় "গল্পের প্রধান চরিত্রে সরমা ও নরেন, বিষয় - ভালোবাসায় প্রতারণা, love story in bengali  এবং  valobashar golpo ও bangla funny jokes আরও পাওয়ার জন্য আমাদের ব্লগ টিকে সাবস্ক্রাইব করে আমাদের সাথে থাকুন, গল্পটি পড়িয়া যদি আপনার ভালো লাগিয়া থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট এবং শেয়ার করিতে ভুলিবেন না। 

bangla love story

Bangla love story online read - বাংলা প্রেমের গল্প

আজকের গল্প - কুয়াশায় 

হ্যারিসন রােড ও আমহার্স্ট স্ট্রিটের মােড়ে নেমে অত্যন্ত বাঁকাচোরা ক’টি গলিপথ পার হয়ে হঠাৎ একটি ছােট্ট রেলিং-ঘেরা জমি কোনােদিন কেউ হয়তাে আবিষ্কার করতে পারে-অনেকে করেছেও। আবিষ্কার কথাটার ব্যবহার এখানে নিরর্থক নয়, কারণ অত্যন্ত কুটিল গলির গােলকধাঁধার ঘােরবার পর ক্লান্ত পথিকের কাছে ঠিক আবিষ্কারের বিস্ময় নিয়েই এই সামান্য জমিটুকু দেখা দেয়। পুরনাে নােনাধরা ইটের মান্ধাতার আমলের তৈরি বাড়িগুলি ওই সামান্য রুগ্ন ঘাসের শয্যাটিকে কারাগারের প্রাচীরের মতাে ঘিরে আছে। 

দেখলে কেমন মায়া হয় ওর ঘাসগুলির বিবর্ণতায় যেন পৃথিবীর দিগন্তবিস্তৃত প্রান্তরগুলির বিচ্ছেদের কান্না আছে মিউনিসি -প্যালিটির বাঁধানাে দপ্তরে এ জমিটুকুর বড় গােছের একটা নাম নিশ্চয়ই আছে। সে-নাম আমরা জানি না, জানবার প্রয়ােজনও নেই। নিকটবর্তী থানার পুরােনাে খাতার এই ভুখণ্ডটিকে জড়িয়ে যে-বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে, তাই নিয়ে আমাদের কাহিনী। পুলিশের লােকেদের সম্বন্ধে যতরকম নিন্দাই বাজারে চলুক না কেন, ভাব-প্রবণতার অপবাদ তাদের নামে এখনও কেউ বােধ হয় দেয়নি। তাদের বিবরণ সাহিত্য হবার কোনাে দূরাশা রাখে না।


পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনাকে প্রতিদিনের Share Market এর রিপাের্টের মতাে বর্ণহীন ও নীরস করে লেখবার দুলর্ভ বিদ্যা তাদের আয়ত্ব। তবু এই সামান্য রেলিং-ঘেরা তিন কাঠা পরিমাণ জমিটির ভেতরে দশ বছর আগে শীতের এক কুয়াশাচ্ছন্ন প্রভাতে এমন একটি ব্যাপার ঘটেছিল, যা তাদের নির্লজ্জ কলমের নিষ্ঠুর আঁচড় সয়েও আজও বুঝি রহস্যমণ্ডিত হয়ে আছে। চারিদিকের জীর্ণ বাড়িগুলি থেকে ততােধিক জীর্ণ যে-মানুষগুলি আজ সন্ধ্যার ক্ষণিকের অবসরে এই ছােটো জমিটুকুতে দুর্বল নিশ্বাস নিতে আসে, তারা অনেকেই হয়তাে সে-কথা আজ ভুলে গেছে কিংবা না ভুললেও স্মৃতির পুরনাে পাতা সযত্নে তারা চাপা দিয়েই রাখে উল্টে দেখবার ইচ্ছা বা অবসর কিছুই তাদের নেই। 

তবু এখন কেউ-কেউ ছেলেমেয়েদের লােহার রডের তৈরি দোলনার কাছে এসে থমকে দাঁড়ায়। দশ বৎসর আগের একটি প্রভাতের কথা ভেবে হয়তাে শিউরে ওঠে। প্রভাত-সূর্যের আলাে সেদিন তখনও ওই জমিটুকুর ঘন ধোঁয়াটে কুয়াশাকে তরল করবার সুযােগ পায়নি। সেই অস্পষ্ট কুয়াশায় দেখা গেছিল ছেলেদের দোলনার ওপরাকার দণ্ড থেকে, কণ্ঠে মলিন বোরখা জড়ানাে একটি নারীর মৃতদেহ ঝুলছে। মেয়েটি কিশােরী নয় ; কিন্তু পূর্ণযৌবনাও তাকে বুঝি বলা চলে না। পরনে তার বিধবারা মলিন বেশ; কিন্তু গলায় একটি সােনার হার। তা থেকে ও তার মুখ দেখে ভদ্র গৃহস্থ-পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক অনুমান করা কঠিন নয়। মাথার দীর্ঘ রুক্ষ চুলের রাশ তার মুখ ছেয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল ; কিন্তু তারই ভিতর দিয়ে তার ঈষৎ-বিকৃত মুখ যারা দেখেছে তারা কখনও তা ভুলতে পারবে বলে মনে হয় না। 

সে-মুখের অসীম ক্লান্তি ও অসহায় কাতরতা মৃত্যুও যেন মুছে দিতে পারেনি। খবর পেয়ে পুলিশের লােকের আসতে দেরি হয়নি। এসমস্ত ব্যাপারে যা দস্তুর তা করতেও তারা ত্রুটি করেনি ; তবু এই মৃত্যু-রহস্যের কোনাে কিনারাই শেষ পর্যন্ত হল না। যে-কুয়াশার মাঝে মেয়েটির জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল, তারই মতাে দুর্ভেদ্য রহস্য তার সমস্ত অতীত জীবনেতিহাস আচ্ছন্ন করে রইল। এই মৃত্যুর লজ্জা ও গ্লানি গায়ে পেতে নেবার জন্য কোনাে আত্মীয়স্বজন তার থাকলেও, এগিয়ে এল না। নামহীনা, গােত্রহীনা, পৃথিবীর অপরিচিতা হতভাগিনী নারীদের এক প্রতীকই বুঝি সেদিন নিশান্তের অন্ধকারে এই রেলিং-ঘেরা জমিটুকুর নির্জনতার উদ্বন্ধনে সকল জ্বালা জুড়িয়েছে, ভাবতে পারতাম কিন্তু তা সত্য নয়। 


এই শােচনীয় সমাপ্তির কোথাও একটা আরম্ভ ছিল। এই নিদারুণ কাহিনীর গােড়াকার পরিচ্ছেদগুলি জানতে হলে তেরাে বছর আগেকার চকমেলানাে যে বিশাল বাড়িটিতে প্রবেশ করতে হবে তার দেউড়ির, দারােয়ান থেকে জীর্ণ দেয়ালের প্রত্যেক ফাটলে অস্তমিত গৌরবের চিহ্ন এখনও সুস্পষ্ট। বৃদ্ধা রূপসীর মতাে আজও তার গায়ে অতীত গৌরবের দিনের অলংকারের দাগ মেলায়নি ; তার লােল চর্মের মালিন্যকে ব্যঙ্গ করে আজও সে-চিহ্নগুলি মানুষের চোখকে ব্যথিত করে। জীর্ণ শতচ্ছিন্ন মলিন উর্দি পরে আজও পুরনাে দিনের বৃদ্ধ দারােয়ান দরজায় পাহারা দেবার ছলে বসে-বসে ঝিমােয়। পাহারা দেবার আর তার কিছু অবশ্য নেই। বড়াে রাস্তার ওপর বাড়ির আসল দেউড়ির দিক পূর্বতন উত্তরাধিকারী দেনার দায়ে অনেকদিন আগেই বেচে দিয়েছেন। 

গলির ওপর আগের আমলের খিড়কি-দরজাই এখন একটু অদল-বদল করে দেউড়িতে পরিণত হয়েছে। সে-দেউড়ি পার হয়ে সে-কালের বাঁধানাে আঙিনা অতিক্রম করে যে-মহলে পৌঁছনাে যায়, চারদিক থেকে সংকুচিত হয়ে এলেও তার আয়তন বড়াে কম নয়। মৌচাকের মতাে সেই-মহলের কুঠুরির পর কুঠুরি এখনও গুনে ওঠা ভার। কিন্তু পাহারা দেবার সেখানে কিছু নেই। অধঃপতিত প্রাচীন জমিদার-বংশের দরিদ্র উত্তরা-ধিকারীরা সেই অসংখ্য কুঠুরির পর কুঠুরিতে ভিড় করে বাস করে। কারুর সঙ্গে কারুর তাদের বিশেষ সম্পর্ক নেই। অতীত দিনের স্মৃতি ছাড়া সযত্নে রক্ষা করার মতাে মূল্যবান জিনিসেরও তাদের একান্ত অভাব। তবু চিরদিনের রেওয়াজ-মতাে বৃদ্ধ দারােয়ান দরজায় বসে থাকে এবং তারই পাশের কুঠুরিতে নায়েব, গােমস্তা, সরকার প্রভৃতির ব্যস্ত কলরবের পরিবর্তে সে-যুগের শেষ চিহ্ন এ-পরিবারের বিশ্বাসী সরকার মহাশয়ের তামাক খাবার মৃদু শব্দ শােনা যায়।

 যৎসামান্য যে-জমিদারি এখনও অবশিষ্ট আছে তিনিই একাকী তার তত্ত্বাবধান করেন ও বর্তমানের অসংখ্য উত্তরাধি-কারীদের মধ্যে তারই যৎসামান্য আয় বণ্টন করার বন্দোবস্তও তাকে করতে হয়। অন্দরমহলের হেঁশেল ও বাইরের এই একক সরকার মহাশয়ের দপ্তর এই বৃহৎ পরিবারের বিচ্ছিন্ন একান্তবর্তিতার এই দুটি চিহ্নই এখনও সরকারের দপ্তর একান্ত সংকুচিত হয়ে এলেও হেঁশেল প্রকাণ্ড। পূর্বতন কর্তার উইলের নির্দেশমত জমিদারির আয়েই তা চলে। বিরাট মহলের সমস্ত কুঠুরির অধিবাসীদের দু-বেলা এখন শুধু তার সঙ্গে আহারের সম্পর্কটুকু আছে। কিন্তু সে-সম্পর্কের গুরুত্ব বড়াে কম নয়। তিন-তিনটে বড়াে উনুন দিবারাত্র সেখানে নিভতে পায় না। মােক্ষদা ঠাকরুন দাঁতে গুল দিতে-দিতে চরকির মতাে রাতদিন ঘুরে বেড়ান। “হ্যাগাে রামের মা, এই কি চাল ধােবার ছিরি! একবার কলে বসিয়েই হৈতুলে এনেছ বুঝি!” তারপর আর এক পাক ঘুরে এসে বলেন-“নাঃ, জাতজন্ম তুই আর রাখতে দিবি না বিন্দী, ওটা আঁশ-বঁটি লাে! 


আরও পড়ুন গল্পঃ মনি 

নিরিমিষ্যি হেঁশেলের কুটনােগুলাে কুটলি তাে ওতে? তাের আক্কেল কবে হবে বলতে পারিস?” পিছন দিক ঘুরে বলেন “তবেই হয়েছে মা! তােমার মতাে নিড়বিড়ে লােককে কুটনাে কুটতে দিলেই এ-বাড়ির লোক খেতে পেয়েছে, আজ সন্ধের আগে রান্না নামবে না!” মেয়েটি লজ্জিত হয়ে আরও দ্রুত হাত চালাবার চেষ্টা করে। মােক্ষদা ঠাকরুন আবার বলেন, “তােমার নামটা ভুলে গেলাম ছাই।” মেয়েটি মাথা নিচু করে মৃদু কণ্ঠে বলে, “সরমা।” “হ্যা হ্যা সরমা আমার ভাগ্নে-বউয়ের নামও যে ওই! ঠিক তােমারই মতে নামে চেহারায় হুবহু কি এক হতে হয় মা রূপে গুণে কি বলব , একেবারে লক্ষ্মী-ঠাকরুনটি ছিল।” মুখে এক খামচা গুল দিয়ে তিনি আবার বলেন, “দিদির পােড়া কপালে অমন গুণের বউ বাঁচবে কেন! সােয়ামীর কোলে মাথা রেখে ছেলে বুকে করে লবডঙ্কা দেখিয়ে চলে গেল।” 

তারপর হঠাৎ সংকুচিত মেয়েটির সিন্দুরবিহীন সীমন্তরেখার দিকে চোখ পড়তেই বােধ হয় কথাটা পাল্টে নিয়ে তিনি বললেন, “অত সূক্ষ্ম কাজে চলবে না মা বলতে নেই, তবে এ রাবণের গুষ্টির রান্না মােটামুটি না সারলে কি হয়! হাত চালিয়ে নাও, হাত চালিয়ে নাও ; ও খােলা-টোলা একটু-আধটু থাকলে আসবে যাবে না।” পরক্ষণেই মােক্ষদা ঠাকরুনকে নূতন দিকের তত্ত্বাবধানে যেতে হয়। সরমা যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি কাজ সারবার চেষ্টা করে ; কিন্তু বেশিক্ষণ তার নির্বিঘ্নে কাজ করার অবসর মেলে না। “ও কি কুটনাে হচ্ছে, না গরুর জাবনা কাটছ বাছা? দুমদাম করে যা হােক করলেই তাে হয় না। গরু-বাছুর নয়, মানুষে খাবে!” সরমা চকিত ভীত হয়ে চোখ তুলে তাকায় এবং চিনতেও তার দেরি হয় না। 

গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, গেরুয়া কাপড় পরা এই বিশালকায় স্ত্রীলােকটির সাথে ঘনিষ্ঠ পরিচয় না হলেও কয়দিনেই সে তাকে ভয় করতে শিখেছে। ক্ষ্যান্ত পিসি বলে তিনি সাধারণত পরিচিত, কিন্তু হেঁশেলের মেয়েরা গােপনে বলে, “সেপাই” এবং বােধ হয় অন্যায় করে না। স্ত্রীলােকটির চেহরায়, ব্যবহারে কথায়-বার্তায় এমন একটি পুরুষ জবরদস্ত ভাব আছে যা দেখলে স্বভাবতই ভয় হয়। ক্ষ্যান্ত পিসি অত্যন্ত কটুকণ্ঠে এবার বলেন “হাঁ করে তাকিয়ে আছে কি? ইংরিজি ফার্সি বলিনি। বাংলা কথাও বােঝাে না!” সরমা থতমত খেয়ে, তাড়াতাড়ি অথচ পরিপাটি করে কুটনাে কোটবার অসম্ভব চেষ্টায় মনােনিবেশ করে। কিন্তু রাশীকৃত তরকারির দিকে চেয়ে তার ভয় হয়। সত্যই এক বেলার মধ্যে তা সেরে ফেলবার কোনাে সম্ভাবনা সে দেখতে পায় না। ক্ষ্যান্ত পিসির তাড়াতাড়ি সেখান থেকে নড়বারও কোনাে লক্ষণ নেই। অনেকক্ষণ ধরে ভ্রুকুঞ্চিত করে তাকে বিশেষভাবে নিরীক্ষণ করে হঠাৎ তিনি বলেন, “তুমি আমাদের ফটকের বউ না গা?”


কথাটা বুঝতে না পেরে সরমা অবাক হয়ে আবার মুখ তুলে চায়। তার মৃত স্বামীর নাম সে জানে এবং তা ‘ফট্‌কে’ নয়। ক্ষ্যান্ত পিসি তার বিস্ময় দেখে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলেন, “আকাশ থেকে পড়লে কেন, বাছা! চোখের মাথা তো খাইনি, যে একবার দেখলে চিনতে পারব না! সেই তাে ধুলাে পায়ে ফিরে এসে ফটকে আর মাথা তুললাে না, এক রাত্রে কাবার। তারই বউ তুমি?” এবার সরমা মাথা নিচু করে থাকে। এ-বাড়িতে তারই মতাে আরও হতভাগিনীর জীবনে ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে এ-কথা বিশ্বাসযােগ্য নয়। বিয়ে যখন তার হয়েছে, তখন সে তেরাে বছরের বালিকা মাত্র এবং তখনকার দু'দিনের পরিচয়ে স্বামীর সংবাদ তার জানবার কথাও নয়। 

তবু এ-বাড়িতে তার স্বামীর ডাকনাম যে ওই ছিল, এখন আর তার তা বুঝতে বাকি থাকে না। ক্ষ্যান্ত পিসি খানিক চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে বলেন “কি কপাল করেই এসেছিলে বাছা, ফটকের মার সংসারটা ছারখার হয়ে গেল।” তার ভাগ্য সম্বন্ধে এই উপাদেয় মন্তব্যগুলি সরমাকে আর কতক্ষণ সহ্য করতে হত বলা যায় না, কিন্তু মােক্ষদা ঠাকরুন হঠাৎ ফিরে আসায় সে রেহাই পায়। “তুই আবার এখানে ফপরদালালি করতে এলি কেন বলতাে ক্ষান্ত ?” বলে মােক্ষদা ঠাকরুন এসে দাঁড়ান। তারপর সরমাকে দেখিয়ে বলেন-“একে নিড়বিড়ে মানুষ, তার ওপর তাের বক্তিমে শুনতে হলে এ-বেলায় আর ওকে কুটনাে শেষ করতে হবে না।” 

বাড়ির মধ্যে এই এক মােক্ষদা ঠাকরুনের সামনেই ক্ষ্যান্ত পিসির সব আস্ফালন শান্ত হয়ে যায়। ভেতরে-ভেতরে মোক্ষদা ঠাকরুনের কর্তৃত্বের হিংসা করলেও তার কছে। ক্ষ্যান্ত পিসি, কেন বলা যায় না একেবারে কেঁচো হয়ে থাকেন। এক গাল হেসে আপ্যায়িত করবার চেষ্টা করে ক্ষ্যান্ত পিসি বলে “ফপুরদালালি করব কেন দিদি! চিনি-চিনি মনে হল, তাই শুধােচ্ছিলুম তুমি কি আমাদের ফটকের বউ? সেই এতটুকু বিয়ের কনেটি দেখেছিলুম, আর তাে তারপর আসেনি!” অত্যন্ত চটে উঠে মােক্ষদা ঠাকরুন বলেন “তাের আক্কেল অমনিই বটে! শুধােবার আর কথা পেলিনে!” অপ্রস্তুত হয়ে ক্ষ্যান্ত পিসির সরে পড়তে দেরি হয় না। “একা তােমার কর্ম নয়। 

মা” বলে আরেকটা বঁটি টেনে নিয়ে মােক্ষদা ঠাকরুন সরমার সঙ্গে কুটনাে কুটতে বসে যান। সরমা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। ছেলেবেলায় মার সঙ্গে তীর্থযাত্রার গিয়ে সরমাকে একবার এক ধর্মশালায় থাকতে হয়েছিল। ঘরে-ঘরে অগণন যাত্রীর ভিড়। একই বাড়ির ভেতর পাশপাশি তাদের ছােটো-ছােটো সংসার দু-দিনের জন্য পাতা হয়েছে অথচ কারুর সঙ্গে কারুর সম্বন্ধ নেই। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়, যেন কোনাে বৃহৎ পরিবারের লােকে বাড়ি গমগম করছে অথচ ভেতরে একান্ত অপরিচিত, পরস্পরের প্রতি নিতান্ত উদাসীন মানুষের দল। এ-বাড়িতে ক'দিন বাস করে সরমার অস্পষ্টভাবে সেই ধর্মশালার কথাই মনে পড়ে বারবার। এ যেন চিরন্তন একটা ধর্মশালা। 


ভােরের আলাে দেখা দিতে না দিতে এ-বাড়ির হট্টগােল শুরু হয়। ঘরে-ঘরে বিভিন্ন সংসারের বিভিন্ন জীবনযাত্রার কলরব, উঠানে পরিচিত অপরিচিত বালক বৃদ্ধ বৃদ্ধার হাট। হেঁশেলে তাে যজ্ঞবড়ির মতাে ব্যস্ততা লেগেই আছে। দুপরের খাওয়ার পাট চুকতে চুকতেই রাত্রের আহারের আয়ােজন শুরু হয়ে যায়। সমস্ত সংসার-যাত্রাটা বিরাট কলের চাকার মতাে অমােঘভাবে চলে, অবশ্য অত্যন্ত পুরনাে ভাঙা তৈলবিহীন কলের চাকার মতাে এবং তারই কোথায় একটি ছােটো অংশের মতাে আটকে গিয়ে সরমা আর সারাদিন নিঃশ্বাস ফেলবার অবসর পায় না। 

গভীর রাত্রে সমস্ত কাজ শেষ করে মােক্ষদা ঠাকরুনের সঙ্গে নীরবে ছােটো একটি কুঠুরিতে যখন মলিন একটি শয্যায় সে শুতে যায়, তখন ক্লান্তিতে তার চোখের পাতা জড়িয়ে এসেছে। নিজের মনের সঙ্গে দু'দণ্ড মুখােমুখি হয়ে বসবার তার আর উৎসাহ বা অবসর কিছু নেই। তবু সরমার দিন ভালােই কাটে, অন্তত দুঃখ করবার কিছু আছে, এ-কথা কোনােদিন তার মনে হয়নি। বিধবা হবার পর ক’বছর তার বাপের বাড়িতে কেটেছে। বাপ-মা মারা যাবার পর ভায়েরা গলগ্রহ বলেই তাকে যে শ্বশুর বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে গেছে, এ-কথা সে জানে এবং তার জন্যেও তার কেনাে ক্ষোভ নেই। সিথির সিন্দুর মুছলে বধূ ও কন্যারা হেঁশেলে আশ্রয় পায়, এই এ-বাড়ির সনাতন নিয়ম। সে-নিয়ম অনুসারেই শ্বশুরবাড়িতে পা দেবা মাত্র রন্ধনশালার বিরাট চক্রে সে জড়িয়ে গেছে। 

এবং পরিশ্রম এখানে যতই থাক, সে-চক্রের সঙ্গে আবর্তনে দিন ও রাত্রি যে তারা নিশ্চিন্তভাবে পার হয়ে যায়, এইটাই তার পরম শান্তি। হেঁশেলের বাধা জীবন-যাত্রাতেও বৈচিত্র্যের একেবারে অভাব আছে বলা যায় না। দোতলার পুবদিকের কোণের ঘরের বউটি ভারি মিশুক। সকাল হতে না হতে একটা বাটিতে খানিকটা বার্লি গুলে নিয়ে এসে হয়তাে বলে, “দাও তাে ভাই উনুনে একটু তাতিয়ে ছেলেটার রাত থেকে জ্বর। সরমা তাড়াতাড়ি বার্লি ফুটিয়ে এনে দেয়। বউটি যাবার সময়ে বলে, “দুপুরে পারাে তো একবার যেও না ভাই, কথা আছে!” সরমা ঘাড় নেড়ে জানায় “যাবাে।” বউটি যেতে না যেতে পাশ থেকে কটু কণ্ঠে ব্যঙ্গ করে হেঁশেলের আর একটি মেয়ে বলে, “একটু যেও না ভাই, কথা আছে।” 

কথা মানে তাে ছেলের কাথা গুলাে সেলাই করিয়ে নেওয়া! খুব ধড়িবাজ বউ যা হােক! তােকেও যেমন হাবা মেয়ে পেয়েছে, তাই নাকে দড়ি দিয়ে খাটিয়ে নেয়!” কথাগুলাে যে একেবারে মিথ্যা নয় তা তাে সরমাও কিছু-কিছু বােঝে ; তবু সলজ্জভাবে একটু হেসে বলে, “না, না, নাকে দড়ি দিয়ে খাটিয়ে নেবে কেন? একলা মানুষ, ছেলেপুলে নিয়ে সামলাতে পারে না, তাই...” সরমাকে কথাগুলাে আর শেষ করতে হয় না। নলিনী খরখর করে বলে ওঠে, ‘আমার ঘাট হয়েছে গাে ঘাট হয়েছে, আর তােমায় কিছু বলব না। তােমার এত দয়া, মায়া, গতর থাকে করগে যাও না। আমার বলতে যাওয়াই ঝকমারি!” তারপর রাগে গরগর করতে-করতে নলিনী চলে যায়। সরমা মনে-মনে একটু হেসে চুপ করে থাকে। 


নলিনী মেয়েটিকে এই কদিনে সে বেশ ভালাে করেই চিনেছে। বয়স নলিনীর তার চেয়ে বিশেষ বেশি নয়, কিন্তু দেহের অস্বাভাবিক শীর্ণতার জন্য তাকে অনেক বড়াে দেখায়, তার শুকনাে শীর্ণ মুখে বিরক্তি যেন লেগেই আছে। প্রসন্ন মুখে তাকে কখনও কথা বলতে এ পর্যন্ত সে শােনেনি। তবু এই উগ্র মেয়েটির কঠিনতার অন্তরালে কোথায় যেন গােপন স্নেহের ফল্গুধারা প্রকাশের সুযােগের অভাবে রুদ্ধ হয়ে আছে বলে সরমার মনে হয়। প্রথম দিন যেভাবে তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, সে-কথা মনে করলে এখনও সরমার হাসি পায়। সবে সেদিন সে এ-বাড়িতে এসেছে। মােক্ষদা ঠাকরুনের জিম্মায় সরকার মশাই তাকে অন্দরমহলে এসে রেখে গেছেন। 


সারাদিন অপরিচিত লােকের মাঝে মােক্ষদা ঠাকরুনের ফরমাশে ছোটোখাটো হেঁশেলের কাজ সে করেছে ; কিন্তু আলাপ কারুর সঙ্গে তার বিশেষ হয়নি। মােক্ষদা ঠাকরুনের ভােলা মন। রাত্রে সকলের খাওয়া-দাওয়ার পর সরমার শােবার জায়গার ব্যবস্থা যে করা দরকার, এ-কথা বােধ হয়। মনেই ছিল না। লজ্জায় সরমা সে-কথা কাউকে জিজ্ঞাসা করতেও পারেনি। একে-একে সবাই হেঁশেল ছেড়ে চলে যাওয়া সত্ত্বেও সে হতাশভাবে রান্নাঘরের একধারে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। হেঁশেলে চাবি দেবার ভার নলিনীর ওপর। দরজায় তালা লাগাতে গিয়ে তাকে দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে সে রুক্ষকণ্ঠে বললে, “ঢং করে এখনে দাঁড়িয়ে আছাে কেন বাপু, রাত একটা বাজতে যায়, শুতে যাও না!” দুঃখে হতাশায় তখন সরমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এসেছে। অস্ফুট স্বরে সে শুধু বললে, ‘কোথায় শোব?” অত্যন্ত কটু কষ্ঠে “আমর মাথায়!” 

বলে নলিনী চলে যাচ্ছিল, কিন্তু একটু পরে কি ভেবে ফিরে এসে সে বললে, “তুমি আজ নতুন এসেছ, না?” এই অসহায় অবস্থায় নলিনীর কণ্ঠস্বরের রুক্ষতায় সরমার চোখে তখন জল এসেছে। এ-কথার সে উত্তর পর্যন্ত দিতে পারলে না। কিন্তু নলিনী তখন উত্তরের প্রতীক্ষা না করে একেবারে মােক্ষদা ঠাকরুনের ঘরে গিয়ে হাজির হয়েছে। নলিনীর তীক্ষ্ণ কণ্ঠ সরমা সেখান থেকেই শুনতে পাচ্ছিল “বুড়াে হয়ে তােমার ভীমরতি হয়েছে, না! কিরকম আক্কেলটা তােমার বল দেখি? নিজে তো বেশ আয়েশ করে নাক ডাকিয়ে ঘুমচ্ছ, আর একটা মেয়ে যে চোদ্দ পাে অধর্ম করে তােমাদের আশ্রয়ে এসেছে তার শােবার কি ব্যবস্থা করেছ শুনি?” মােক্ষদা ঠাকরুন অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে ব্যস্ত- হয়ে এসে বলেছিলে “ছি, ছি, বড়াে ভুল হয়ে গেছে মা! এক্কেবারে হুঁশ ছিল না। এসাে মা এসাে, এই আমার ঘরেই তােমার শােবার ব্যবস্থা করেছি।” নলিনীর মুখ কিন্তু তবু থামেনি। 

মােক্ষদা ঠাকরুনকে যতদূর সম্ভব বাক্যবাণে জর্জরিত করে শেষে সরমার দিকে ফিরে সে বলেছিল, “শােবে তাে বিছানাপত্র কই?” সরমা একটি তােরঙ্গ ছাড়া আর কিছুই আনেনি ; সেটা বৃহৎ রান্নাঘরের রকের এক কোণে তখনও পড়ে ছিল। তারই দিকে চেয়ে কাতর-ভাবে বলেছিল “তা তাে কিছু আনিনি।” “না, তা আনবে কেন? এখানে তােমার জন্যে জোড়পালঙে গদি পাতা রয়েছে যে! এখন শোওগে যাও খালি মেঝেয়।” মােক্ষদা ঠাকরুন সরমার মুখের অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি বলেছিলেন “আহা-হা, না এনেছে, না এনেছে ; তা বলে খালি মেঝেয় শুতে যাবে কেন? চলাে মা চলাে, আমার বিছানাপত্তর থেকে দু-জনের কোনােরকমে হয়ে যাবে এখন।” “তা খুব হবে এখন! 


তােমার তাে আছে একটা ছেড়া পচা কাথা, তার দু-পিঠে দু-জন শুয়াে।” কটু কণ্ঠে ব্যঙ্গ করে নলিনী চলে গিয়েছিল। কিন্তু খানিক বাদেই মােক্ষদা ঠাকরুনের ঘরে ঢুকে সজোরে একটা চাদর সমেত তােশক ও বালিশ মেঝেয় আছড়ে ফেলে নলিনী বলেছিল “নাও গাে নাও, এখন শ্রীঅঙ্গ ছড়াও। রাত দুপুরে যত হ্যাঙ্গামা।” মােক্ষদা ঠাকরুন তখন নিজের যৎসামান্য শয্যাদ্রব্য সরমাকে ভাগ করে দেবার ব্যবস্থা করছিলেন। নলিনীর ব্যবহারে অবাক হয়ে বললেন, “তােশক বালিশ সব দিয়ে গেলি, তা তুই শুবি কিসে লা?” “থাক, থাক, অত আদিখ্যেতার দরকার নেই। আমার ভাবনা তাে আমি কাউকে বলিনি।' বলে সজোরে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে নলিনী চলে গিয়েছিল। মােক্ষদা ঠাকরুন হেসে সরমাকে বলে-ছিলেন, “কিছু মনে করাে না মা ; যেটুকু ধার ওর মুখে নইলে....” নইলে যে কি মােক্ষদা ঠাকরুন বলে দেবার আগেই সরমা তখন বুঝে নিয়েছে। 

তারপরও নলিনী কোনােদিন প্রসন্নমুখে তার সঙ্গে আলাপ করেছে বলে সরমা মনে করতে পারে না তবু কেমন করে কোথা দিয়ে দু-জনে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। নলিনী দাঁত খিচিয়ে ছাড়া কথা বলে না, কিন্তু সরমার সঙ্গও ছাড়ে না। আজও সে খানিক বাদে ঘুরে এসে আপন মনেই গজগজ করতে থাকে “টান তাে কত! ছেলের কাঁথা সেলাই করবার বেলা একটা কথা আছে ভাই!’ ঘরদোরগুলাে সাফ করিয়ে নেবার বেলা—‘তুই ভাই ঘর গুছােতে বড়াে ভালাে পারিস। কই, বাপের বাড়ি থেকে তত্ত্ব আসার দিন তাে ভুলেও একবার ডাকল না!” সরমা এবার হেসে ফেলে বলে, “তুমি এবার হাসালে নলিনীদি! বাপের তত্ত্ব এলে তা আমায় ডাকবে কেন?” “তা বৈকি! বাঁদিগিরি করতে ডাকে তাে তা হলেই হল।” সরমা নলিনীকে আর কিছু বলতে যাওয়া বৃথা বুঝে চুপ করে থাকে। নলিনী নিজের মনেই একসময়ে বকে বকে শান্ত হবে, সে জানে। 

বছরের পর বছর ঘুরে যায়। বেশির ভাগ একঘেয়েমি ও কিছু বৈচিত্র্য নিয়ে সরমার জীবন এমনি মসৃণভাবেই মনে হয় কেটে যাবে। সে-জীবনকে কক্ষচ্যুত করবার মতাে এমন কি-ই বা ঘটতে পারে! চারিধারের চিরন্তন পান্থশালায় যে-জীবনযাত্রা চলে তার সঙ্গে বিশেষ কিছু সংস্পর্শ সরমার নেই। তার নিজের জীবন তো দিনের পর দিন প্রায় একই ঘটনা-সমষ্টির পুনরাবৃত্তি। বড় জোর একদিন মােক্ষদা ঠাকরুন ডেকে বলেন, “তরকারি-টরকারিগুলাে গুছিয়ে এক থালা ভাত বেড়ে নিয়ে আয় তাে মা আমাদের ঘরে। আমি ততক্ষণে জল ছড়া দিয়ে আসনটা পেতে ফেলি গে।” রান্নাঘরের পাশের ঘরেই সাধারণত সকলের খাবার জায়গা হয়। আজ এই বিশেষ বন্দোবস্তে একটু অবাক হলেও কারণ জিজ্ঞেস করা সরমা প্রয়ােজন মনে করে না। 

কিন্তু ভাতের থালা নিয়ে ঘরে ঢুকেই অপরিচিত পুরুষ দেখে সে দরজার কাছে। লজ্জায় জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। দুটি হাতই তার ভাতের থালা ও ব্যঞ্জনের বাটি ধরতে গিয়ে জোড়া হয়ে আছে। মাথার ঘােমটাটা পর্যন্ত ভালাে করে তুলে দেবার উপায় নেই। মােক্ষদা ঠাকরুন তাড়াতাড়ি বলেন, “ওমা, অমন করে আবার থমকে দাঁড়ালি কেন? আরে ও যে নরু, আমার ভাইপাে ! ওকে আর লজ্জা করতে হবে না!” তার ভাইপাে বলে লজ্জা করবার কোনাে কারণ কেন যে নেই, তা বুঝতে না পারলেও ভাতের থালা হাতে করে দাঁড়িয়ে থাকাটা সরমার বেশি অশােভন মনে হয়। অত্যন্ত কুণ্ঠিতভাবে আসনের সামনে থালাটা সে নামিয়ে দিয়েই তাড়াতাড়ি ঘরের বার হয়ে যায়। 


মােক্ষদা ঠাকরুন পেছন থেকে হেঁকে বলেন, “একটু নুন হাতে করে আনিস মা! ওর আবার পাতে নুন না হলে চলে না।” মাথার ঘােমটা ভালাে করে টেনে এবার সরমা নুন দিতে আসে। কিন্তু নুন দিতে গিয়ে হঠাৎ হাসির শব্দে সে চমকে ওঠে। “তােমরা কি আমায় নােনা ইলিশ করে তুলতে চাও পিসিমা?” মােক্ষদা ঠাকরুন তাড়াতাড়ি সামনে এসে হেসে বলেন, “দেখেছ, বেটির বুদ্ধি! নুন দিতে বলেছি বলে কি সেরখানেক নুন দিতে হয় পাগলি! অত নুন মানুষ খেতে পারে?” সরমা লজ্জায় জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মােক্ষদা ঠাকরুনের ভাইপাে নরু অর্থাৎ নরেন বলে “এ-বাটিটা তুলে নিয়ে যেতে বলাে পিসিমা–দরকার হবে না।” পিসিমা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন “সে কি রে! ও যে মাছের তরকারি। তাের ওসব বাই আছে বলে পুকুরের জ্যান্ত মাছ কিনে আনিয়ে রেধেছি যে!” 

“জ্যান্ত-মরা কোনাে মাছই যে খাই না আর।” মােক্ষদা ঠাকরুন অত্যন্ত ক্ষুন্ন হয়ে অনুযােগ করতে শুরু করেন “এসব বিদঘুটে বুদ্দি আবার কবে থেকে হয়েছে? এই বয়সে মাছ ছেড়ে দিলি কোন দুঃখে..” নরেন হেসে বলে, “মাছ খাই না বলে হা-হুতাশ না করে নিরামিষ তরকারি আর একটু বেশি করে আনতে বলাে পিসিমা। পাড়া-গেঁয়ে মানুষ-লজ্জার মাথা খেয়েও সহজে পেট ভরে না।” “কথার ছিরি দেখেছ!” বলে হেসে মােক্ষদা ঠাকরুন সরমাকে তরকারি আনতে ইঙ্গিত করেন। নরেন একটু গলা চড়িয়ে বলে “তা বলে নুনের মাপে যেন তরকারি না আসে।” তরকারি দেবার জন্য ঘরে ঢুকে সরমা শুনতে পায় মােক্ষদা ঠাকরুন বলছেন “সেই কথাই তাে ভাবি বাবা : অমন লক্ষ্মী পিরতিমের মতাে মেয়ের এমন কপাল হয় পােড়ারমুখাে বিধেতার মাথায় ঝাড।” তাকে দেখেই মােক্ষদা ঠাকরুন চুপ করে যান। 

তার কথা কি সূত্রে উঠেছে বুঝতে পারলেও, সরমা ঘােমটার ভেতর লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। তরকারির বাটিটা নামাতে গিয়ে কাত হয় ; খানিকটা তরকারি মেঝেতে পড়েও যায়। কিন্তু সরমা সেখানে দাঁড়ায় না। অত্যন্ত সামান্য একটি ঘটনা। কোথাও তা দাগ রেখে যায় না, রেখে যাবার কথাও নয়। নিত্য নিয়মিত হেঁশেলের জীবন সমানভাবেই চলে। কিন্তু ঐ সামান্য ঘটনারই দেখা যায় পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। ক্রমশ পুনরা-বৃত্তির চেয়েও বেশি কিছু ঘটে। সরমা বলে, “আলাদা একটা নিরামিষ তরকারি করতে দেব মাসিমা?” মােক্ষদা ঠাকরুন গুল নিতে গিয়ে থতমত খেয়ে বলেন, “ওমা তাই তাে! ভাগ্যিস মনে করে দিয়েছিস। 

বুড়াে হয়ে মাথার কি আর ঠিক আছে? নরু যে মাছ খায় না, তা আর খেয়াল নেই।” নরেনকে আজকাল প্রায় কলকাতা যাতায়াত করতে হয়। এক-একদিন সে অনুযােগ করে বলে, “তােমাদের ওপর বড়াে বেশি জুলুম করছি, না পিসিমা ? আদর ফুরােবার আগে একটা নােটিশ দিও, মানে-মানে সরে পড়ব।” মােক্ষদা ঠাকরুন সরমাকে শুনিয়ে বলেন, “কথার ছিরি দেখেছিস সরাে। তিন নয়, পাঁচ নয়, আমার ভায়ের এক বেটা আমার সঙ্গে উনি কুটুম্বিতা করছেন।” 


সরমার আগের সংকোচ অনেকটা কেটেছে। নরেনের সামনে ঘােমটা না খুললেও মৃদুস্বরে দু-একটা কথা আজকাল বলে। এখানকার রান্না বােধ হয় অরুচি হয়েছে মাসিমা!” নরেন কিছু বলবার আগেই মােক্ষদা ঠাকরুন বলে ওঠেন, “সে-কথা আর বলতে হয় না! যার রান্না খেয়ে ও মানুষ, সে যে কত বড়াে রাঁধিয়ে তা যদি না জানতুম। দাদা তাই ঠাট্টা করে বলত না “আমাদের বাড়িতে জ্বরজ্বারি কারাে কখনও হবে না মোক্ষদা, তাের বউদি যা রাঁধে সব পাঁচন!” নরেন হেসে বলে, “ভাজের রান্না ননদের কোনাে কালে ভালাে লাগে না পিসিমা। কি ভাগ্যি দ্রৌপদির ননদ ছিল না, নইলে মহাভারতে তার রান্নার সুখ্যাতি আর ব্যাসদেবকে লিখতে হত না।” সকলে হেসে ওঠে। 

সরমা মুখে কাপড় দিয়ে বেরিয়ে যায়। দুপুরবেলা মােক্ষদা ঠাকরুন সরমাকে ঘরে ডেকে এনে বলেন, “বেটার কাণ্ড দেখেছিস সরাে।” কাণ্ড দেখে সরমা যতটা অবাক হয়, কেন বলা যায় না লজ্জিত হয় তার চেয়ে বেশি। দু-খানি গরদের থান নরেন দু-জনের জন্য রেখে গিয়েছে। মােক্ষদা ঠাকরুন বলেন, “কখন চুপিচুপি রেখে পালিয়েছে, জানতেই কি পেরেছি ছাই!” কিন্তু তা বলে মােক্ষদা ঠাকরুন অসন্তুষ্ট হয়েছেন মনে হয় না। প্রথমে বলেন বটে—“পয়সাকড়ি ওরা খােলামকুচি মনে করে, জানিস সরাে! নেহাত যদি কিছু দিতেই ইচ্ছে হয়েছিল একটা সুতির থান দিলেই তাে পারতিস বাবু। এ-গরদ কিনতে যাবার কি দরকার। তার পরেই তার মুখে হাসি দেখা যায়। তা হােক, ছেদ্দা করে দিয়েছে, পরিস বাপু। বিধবা মানুষ, পুজো-আচ্চার জন্যে একটু শুদ্ধ বস্তর থাকাও দরকার। আমার পুরনােখানা তাে ধোকরা জালি হয়ে ছিল। নিজের কি আর কেনবার ক্ষমতা আছে! 

ভাগ্যিস নরু দিলে, এখন পরে বাঁচব!” হাত পেতে গরদের থানটা সরমাকে নিতে হয়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায় তার মুখ রাঙা হয়ে ওঠে। মনে-মনে নরেনের ব্যবহারে কেমন যেন একটু অস্বস্তিই সে অনুভব করে। নিজের পিসিমাকে গরদের থান প্রণামী দিতে চায়, সে দিক ; কিন্তু তার সঙ্গে সরমাকেও এমন বিব্রত করা কেন! এ-দান প্রত্যাখ্যান করাও যায় না, কিন্তু নিতেও যে তার বাধে। কিন্তু মােক্ষদা ঠাকরুনের এসব দিকে দৃষ্টি নেই। নিজের খুশিতেই মত্ত হয়ে তিনি বলেন, “পর না মা একবার, দেখি।” সরমার কোনাে আপত্তি তার কাছে টেকে না। সেইখানেতেই তাকে গরদের কাপড়খানি মােক্ষদা ঠাকরুন পরিয়ে ছাড়েন। 

তারপর ধীরে ধীরে যা ঘটে, তার সমস্ত ইতিহাস বর্ণনা করা কঠিন। ভাগ্যের অভিশাপে একান্ত প্রতিকুল আবেষ্টনের মধ্যে যে বীজ চিরদিন নিজের মধ্যে সুপ্ত থাকতে পারত, তাই, দেখা যায় একদিন কোথাকার এতটুকু ইঙ্গিত ও আশ্বাসে হঠাৎ পল্লবিত হয়ে উঠেছে। সরমাকেই বা কি দোষ দেব? স্বামীকে সে চেনবার অবসর পর্যন্ত পায়নি। তার জীবনে প্রথম যে পুরুষ সমবেদনা ও সহানুভূতির ভিতর দিয়ে যৌবনের অপরুপ রহস্যে মণ্ডিত হয়ে দেখা দিলে–সে নরেন। মােক্ষদা ঠাকরুন বলেন, “পড় তাে মা কি লিখেছে?” সরমার পড়তে গিয়ে বারেবারে বেধে যায়। চিঠির খানিকটা পড়ার পরও সরমাকে থামতে দেখে মােক্ষদা ঠাকরুন বলেন, “আর কিছু লেখেনি?” 

সরমা চুপ করে থাকে। আর যা নরেন লিখেছে তা এমন কিছু অসাধারণ নয় ; তবুও সরমার মুখ দিয়ে তা বেরুতে চায় না। কিন্তু মােক্ষদা ঠাকরুনের জিজ্ঞাসু প্রশ্নের উত্তর তাকে শেষ পর্যন্ত পড়তেই হয়। নরেন লিখেছে, “তােমাকে প্রণাম জানাবার সঙ্গে-সঙ্গে তােমার পাতানাে বােনঝিকে আশীর্বাদ করবার লােভটুকু কোনােরকমে সামলে নিলাম পিসিমা। আশীর্বাদ করবার কিই বা আছে? সারাজীবন তােমাদের ওই হেঁশেলের আগুনে শুকিয়ে-শুকিয়ে মরবার চেয়ে বড়াে সৌভাগ্য যার জন্য কল্পনা করতে পারি না, তাকে আশীর্বাদ করার চেয়ে নিষ্ঠুর পরিহাস আর কিছু হতে পারে না।” মােক্ষদা ঠাকরুন কেন বলা যায় না, হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে নেন। সরমার সমস্ত বুকের ভেতরটা কেন যে অমন মােচড় দিয়ে ওঠে, সে ভালাে করে বুঝতে পারে না। কিন্তু সর্বনাশ যা হবার হতে তখন আর বাকি নেই। 

নিজের জীবনের নিরবচ্ছিন্ন ঊষরতার সুখী না হলেও, দুঃখ করবার যে কিছু আছে এ-কথা সরমা এতদিন জানবার অবসর পায়নি। হঠাৎ নরেন তাকে জীবনের গভীরতম দুঃখের সঙ্গে মুখােমুখি করে দাঁড় করিয়ে দেয়। সরমা নিজের প্রতি সমবেদনা করতে শেখে। মরুভূমি হঠাৎ মেঘের চোখ দিয়ে নিজের ব্যর্থতা দেখতে পায়। সরমা নিজেকে সংবরণ করার চেষ্টা করেনি এমন নয়। নরেনের চিঠি পড়বার পর তার মনে যে-ভাঙন ধরে তা নিবারণ করবার জন্যে একবার সে সমস্ত শক্তি প্রয়ােগ করেছে। সারাদিন সে একরাত্রের অস্পষ্টভাবে দেখা স্বামীর মুখ মনে করবার চেষ্টা করে। স্নান করে ভিজে কাপড় তার গায়েই শুকোয়। দোতলার বউটির ঘরে গিয়ে নিজে-নিজেই সে তার ছেলেপুলের জামা সেলাই করতে বসে। তারপর রাত্রে সরমা স্বামীকে স্বপনে দেখে। 

তার বিছানার অত্যন্ত কাছে তিনি এসে দাঁড়িয়েছেন, মনে হয়। মুখে তার প্রসন্ন হাসি। ধীরে ধীরে সরমার বিছানার ধারে বসে একটি হাতে তিনি সরমাকে জড়িয়ে নত হয়ে তার মুখের ওপর ঝুকে পড়েন। কিন্তু এ কি! এ যে নরেনের মুখ! সরমা ধড়মড় করে জেগে উঠে বসে। সারারাত সেদিন আর সে ঘুমোতে সাহস পায় না। অনেকদিন বাদে নরেন আবার এসেছে। পিসিমা উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন, “এই এক মাসে এমন রােগা হয়েছিস কেন রে? গালের হাড়া-টার একেবারে ঠেলে উঠেছে যে। ভালাে করে খাস-টাস না বুঝি।” নরেন হেসে বলে, “এই যদি ভালাে করে না খাওয়ার চেহারা হয় পিসিমা, তা হলে তােমাদের বাড়িতে বােধ হয় দুর্ভিক্ষ লেগেছে। তােমার বােনঝিটির যা দশা দেখছি...” পিসিমা হঠাৎ সরমা সম্বন্ধে সচেতন হয়ে বলেন, “হ্যা রে, মেয়েটা যখন এল কেমন ননীর পুতুলটির মতাে চেহারা! ক’দিনে যেন শুকিয়ে দড়ি হয়ে গেছে!” 

নিজের চেহারার আলােচনায় সরমা লজ্জা পেয়ে ঘরের বার হয়ে যায়! নরেন  সেদিকে চেয়ে কি বলতে গিয়ে থেমে যায়। নরেন শুধু রােগা হয়নি, এক মাসে যেন অনেক বদলে গিয়েছে। খাওয়া-দাওয়ার পর দেখা যায়-নরেন একলা ঘরে অশান্তভাবে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। চলে যাবার আগে একসময়ে সরমার বিছনার তলায় অনেক দ্বিধাদ্বন্দের পর একটি চিঠি সে লুকিয়ে রেখে যায়। সরমার হাতে সে চিঠি দেবার সুযােগ তার মেলেনি এমন নয় ; কিন্তু কেন বলা যায় না। সে-সাহস সে শেষ পর্যন্ত সঞ্চয় করতে পারেনি। সে-চিঠিতে কি সে লিখেছিল কে জানে, কারণ সরমার হাতে সে-চিঠি পড়েনি ; পড়লেই বুঝি ভালাে হত। 

মােক্ষদা ঠাকরুন বিকালে ঘর ঝাঁট দেবার সময়ে তার নিজের ও সরমার দু-জনের বিছানা নতুন করে ঝেড়ে তােলেন। সামান্য একটা কাগজ ঘরের আবর্জনার সঙ্গে বাইরে কোথায় পরিত্যক্ত হয়েছিল কে জানে! কারুর হাতে সে-চিঠি কোনােদিন পড়েছিল কিনা তাও বলা যায় না। পরের দিন নরেন আবার এল। একরাত্রে যেন আরাে পরিবর্তন হয়ে গেছে। পিসিমা বলেন-“এই শীতের রাতে কোথায় শুতে যাস, কষ্ট হয়, হয়তাে! তার চেয়ে সরকার মশাইকে বলে দিই, যে কটা দিন এখানে থাকিস বাইরের ঘরে শােবার বন্দোবস্ত করে দিক।” “আর দরকার হবে না পিসিমা! আজই চলে যাচ্ছি।” পিসিমা অবাক হয়ে বললেন“সে কি রে? এবারে যে এত তাড়াতাড়ি যাচ্ছিস?” বাড়িতে যাচ্ছি না পিসিমা, এবার অনেক দূর! কখনও ফিরব কিনা তাই জানিনা । ”বলে নরেন একটু হাসল। 

পিসিমা রাগ করে বললেন-“যত সব অলক্ষুণে কথা! আর দূর-দূরান্তরে যাবারই বা তাের কিসের দরকার! এত লােকের দেশে অন্ন হচ্ছে তাের হবে না?” নরেন চুপ করে রইল। “জানি না বাপু, যা ভালাে বুঝিস তাই কর।”-বলে পিসিমা অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে বেরিয়ে গেলেন। সরমাও চলে যাচ্ছিল ; কিন্তু নরেন হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে তার পথ রােধ করে বললে, “একটু দাঁড়াও!” নরেনের এরকম চেহারা সরমা কখনও দেখেনি। বিমূঢ়ের মতাে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। খপ করে সরমার হাতটা ধরে নরেন এবার বললে, “তুমি আমার চিঠির উত্তর দেবে না। আমায় ঘৃণা করবে, আমি জানতাম সরমা ; কিন্তু তবু আমি ও চিঠি না লিখে থাকতে পারিনি। আমায় ক্ষমা করতে হয়তাে তুমি পারবে না, তবু এইটুকু শুধু জেনাে যে তােমায় অসম্মান করবার উদ্দেশ্য আমার ছিল না।” 

সরমা এসব কথার কোনাে মানেই খুঁজে না পেয়ে ভীত অস্ফুট স্বরে বললে, “আপনি এসব কি বলছেন?” নরেন সরমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে অত্যন্ত ক্ষুন্ন-স্বরে বলেন, “তুমি তা হলে না পড়েই আমার চিঠি ফেলে দিয়েছ! যাক, ভালােই হয়েছে! নরেন নিঃশব্দে গিয়ে বিছানার ওপর বসে পড়ল। ঘর থেকে চলে যাবার কোনাে বাধাই আর সরমার ছিল না ; কিন্তু যেতে সে পারল না। খানিক চুপ করে থেকে ধরা-গলায় বললে, “কোনাে চিঠি তাে আমি পাইনি!” নরেন এবার অবাক হয়ে বললেন, “চিঠি পাওনি কিরকম? কি হল তা হলে চিঠির!” সরমার বিছানাটা সে নিজেই একবার উল্টেপাল্টে খুঁজে বললে, “এইখানেই তাে চিঠি রেখেছিলাম!” এ-ব্যাপারের গুরুত্ব তখনও সরমা বােঝেনি। এই অবস্থাতেও এবার একটু না হেসে সে পারলে না ; বললে, “বিছানার ভেতরে চিঠি রাখলেই আমি চিঠি পাব এ-কথা আপনি ভাবলেন কেমন করে!” 

নরেনের মুখ তখন কিন্তু আশঙ্কায় পাংশু হয়ে গেছে, সে ভীত স্বরে বললে, “কিন্তু সে চিঠি যদি আর কারও হাতে পড়ে থাকে সরমা?” এ-সম্ভাবনার কথা সরমার মনে এতক্ষণ জাগেনি। নরেনের কথায় হঠাৎ এ-বিপদের গুরুত্ব উপলব্ধি করে শঙ্কিত হয়ে উঠে শেষ আশায় ভর করে সে বললে, “আপনি চিঠি রেখেছিলেন তাে ঠিক!” “রেখেছিলাম বৈকি!” বলে নরেন বিছানাটা আর একবার উল্টেপাল্টে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখল! চিঠি কোথাও নেই। এই বৃহৎ অনাত্মীয় পরিবারে সেই চিঠি কারুর হাতে পড়ার পর কি যে কেলেঙ্কারি হতে পারে তা কল্পনা করে সরমার সমস্ত দেহ তখন আড়ষ্ট হয়ে এসেছে। দোষ তার থাক বা না থাক, এতক্ষণে কথাটা কিরকম কুৎসিতভাবে কত লােকের ভেতর জানাজানি হয়ে গেছে কে জানে! হয়তাে মােক্ষদা ঠাকরুন পর্যন্ত জানতে পেরেছেন!

সকালে হেঁশেলে যা-যা ঘটেছে সমস্তই তার ভীত মনের কাছে এখন বিকৃতরূপে দেখা দেয়। তার মনে হয়, সবাই যেন এ-কথা আগে থাকতে জেনে তার সঙ্গে আজ অদ্ভুত ব্যবহার করেছে। তার স্থির বিশ্বাস হয়, সে ভালাে করে লক্ষ্য না করলেও সকলের দৃষ্টিতেই আজ সন্দেহ ও বিদ্বেষ ছাড়া আর কিছু ছিল না। সরমার পৃথিবী হঠাৎ অন্ধকার হয়ে আসে। এর পর সে সকলের মাঝে মুখ দেখাবে কেমন করে ? সরমা অসহায়ের মতাে হঠাৎ এবার কেঁদে ফেললে। এ-বাড়িতে এসে আর কিছু না শিখুক, কলঙ্ককে সে ভয় করতে শিখেছে। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনার বিপদের পরিমাণটা তার কাছে অস্বাভাবিক-রূপে বড়াে হয়েই দেখা দিল। সরমা না কাদলে কি হত বলা যায় না, কিন্তু তার সেই অশ্রুসজল, কাতর অসহায় মুখ দেখে নরেনের মাথার ভেতরে কি যেন সহসা ওলট-পালট হয়ে গেল। এতদিনের সমস্ত সংযম ভুলে হঠাৎ সরমাকে নিবিড়ভাবে বুকের ভেতর সে জড়িয়ে ধরল।

“কাদবার কি হয়েছে, সরমা! এ-বাড়িতে তােমার কলঙ্ক হয়ে থাকে, তাতেই বা ভাবনা কি! এ-বাড়ি ছাড়া পৃথিবীতে কি আর আশ্রয় নেই।” সরমা উত্তর দিল না কিন্তু নরেনের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করবার চেষ্টাও তার দেখা গেল না। নরেনের বুকে মাথা রেখে ফুলে-ফুলে সে কাদতে লাগল। তার মাথার চুলে গভীর স্নেহভরে হাত বুলােতে-বুলােতে নরেন বললে, “এখান-কার এই নিরর্থক ব্যর্থ জীবন থেকে তােমাকে সরিয়ে নিয়ে যাবার কথাই আমি চিঠিতে লিখেছিলাম সরমা। কিন্তু তা এভাবে সম্ভব হবে তা ভাবিনি। কে জানে, হয়তাে বিধাতারই তাই অভিপ্রায় ; নইলে সে-চিঠি অমন করে হারাবে কেন?” সরমা তবু কথা বললে না। 

কান্না তার তখনও থামেনি ; কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, এ-কান্না যেন তার নিজের মনের হতাশা বেদনা থেকে উঠছে না। নিজের মনের পৃথক কোনাে অস্তিত্বই যেন তার আর নেই। বিপুল প্রবল দুর্বার কোনাে রহস্যময় স্রোতে তাকে যেন এখন ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে ; তার মনের ছােটো-খাটো ভাবনা চিন্তা ভয়ের কোনাে মূল্যই যেন আর সেখানে নেই। নরেন আবার কি বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ কে একটি মেয়ে ঘরের একেবারে ভেতরে এসে তাদের দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। নরেনের মুখের কথা মুখেই আটকে রইল, সরমা অস্ফুট স্বরে ‘নলিনদি’ বলে লজ্জায় একেবারে রাঙা হয়ে উঠল। নলিনী যে-কাজেই আসুক, বেশিক্ষণ সে আর দাঁড়াল না। তাদের দিকে একবার বিস্মিতভাবে তাকিয়ে, যেমন এসেছিল তেমনই নিঃশব্দে সে বার হয়ে গেল। বিমূঢ় নরেন ও সরমা তখনও তেমনিভাবে বাহু-বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছে। 

অনেকক্ষণ পরে নরেন ম্লান হেসে বললে, “আমাদের পথ ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে আসছে সরমা।” সমস্ত দিন সরমা অসুখের নামে সেদিন ঘরেই পড়ে রইল। বাইরে এতক্ষণ কি হচ্ছে, তা কল্পনা করবার সাহস তার ছিল না। বাইরে যাই হােক, কেলেঙ্কারির ঢেউ যে তার ঘর পর্যন্ত এসে তাকে লাঞ্ছিত করেনি, এরই জন্যে সে সকলের কাছে কৃতজ্ঞ বােধ করেছিল। মােক্ষদা ঠাকরুন একসময় ঘরে এসে তার অসুখের খোঁজ নিয়ে গেছিলেন ; কিন্তু তার মুখের দিকে চাইতে পর্যন্ত সরমা সাহস করেনি। তার কুশল-প্রশ্নের ভেতর তিরস্কারের ইঙ্গিত না থাকলেও, আশ্বস্ত হবারও সে কিছু পায়নি। নরেনের প্রস্তাব সম্বন্ধেও সে বিশেষ কিছু ভেবেছে এমন নয়। তার মনের সমস্ত গতিই যেন রুদ্ধ হয়ে গেছে। আনন্দ বিষাদের অতীত কোনাে লােক পৌছে তার হৃদয় স্তব্ধ হয়ে আছে বলে মনে হয়। 

শুধু এইটুকু সে জানে যে, এ-বাড়িতে তার বাস করা এখন থেকে অসম্বভ, তাকে যেতেই হবে। সেদিন গভীর রাত্রে দেখা যায়, সর্বাঙ্গ বােরখায় জড়িয়ে ছায়ামূর্তির মতাে একটি মেয়ে বিরাট জীর্ণ বাড়িটির নির্জন আঙিনা কম্পিত বুকে পার হয়ে চলেছে। অন্দরমহল পার হয়ে বার-বাড়ির আঙিনা। শীতের অন্ধকার রাত্রে তার চারিধারে কুঠুরিগুলি বিশাল অতিকায় জীবের মতাে ভয়ংকর দেখায়। মেয়েটি সে-আঙিনাও পার হয়ে দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়ায়। বৃদ্ধ দারােয়ান পাশে খাটিয়ার নাক ডাকিয়ে ঘুমচ্ছে। মেয়েটি নিঃশব্দে দরজা খােলবার চেষ্টা করে। কিন্তু এ কি! দরজায় যে তালা দেওয়া! এ-দরজা বন্ধ থাকতে পারে, এ-কথা সরমার মনে হয়নি। 

দারুণ হতাশায় তার চোখে জল আসে। হঠাৎ পেছনে কার মৃদু পদশব্দ শুনে তার বুক কেঁপে ওঠে। নিঃশব্দে সে দরজার পাশে সরে দাঁড়ায় বটে; কিন্তু তখন মন তার গভীরতম হতাশায় অসাড় হয়ে গেছে। পদশব্দ আরাে কাছে আসে, তারপর হঠাৎ অন্ধকারে সরমা শুনতে পায় কে যেন খুব কাছে চুপিচুপি তার নাম ধরে ডাকছে। কান্নার আক্ষেপ কোনােরকমে দমন করে চুপি-চুপি বলে, “কে নলিনদি?” “হ্যা রে কালামুখী!” বলে নলিনী আরাে এগিয়ে এসে তার গায়ে হাত দিয়ে তীক্ষস্বরে বলে, “মরতে চলেছ?” সরমা এবার একেবারে যেন ভেঙে পড়ে, দাঁড়াবার শক্তিটুকু যেন তার আর নেই। সেইখানেই ধীরে-ধীরে বসে পড়ে, সে ধরা-গলায় কি যেন বলবার চেষ্টা করে, কিন্তু নলিনী হঠাৎ মৃদুকণ্ঠে তাকে ধমক দিয়ে বলে, “চুপ!” তারপর হঠাৎ তালায় চাবি লাগাবার শব্দে সরমা চমকে উঠে।

নলিনদি করছে কি! দূরের রাস্তার একটা স্তিমিত আলাের রেখা চোখে পড়তেই সরমা বুঝতে পারে দরজা খােলা হয়েছে। বিমূঢ়ভাবে সে উঠে দাঁড়ায়। নলিনী কটু কণ্ঠে বলে, “চিতা তৈরি, আর দাঁড়িয়ে কেন ? যাও।” সরমা সমস্ত সাবধানতা ভুলে, এবার ফুপিয়ে কেঁদে উঠে বলে, “আমি যাব না, নলিনদি।” নলিনী তার কাধে একটা হাত রাখে, কিন্তু পূর্বের মতােই তীব্র-কণ্ঠে বলে “ঢং আর ভালাে লাগে না। আমায় দরজা বন্ধ করতে হবে, যাও।” সরমা হতাশভাবে আর একবার বলে, “কিন্তু নলিনদি “কিন্তু, আর কিছু নেই তাে! মন যার ভেঙেছে, ঘরে থেকে ভড়ং করে তার কি স্বর্গ হবে?” সরমা ধীরে-ধীরে বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। হঠাৎ তার হাতের মধ্যে কি একটা শক্ত মােড়ক গুজে দিয়ে নলিনী বলে, “এই তােমার গলায় দড়ি!” তারপর দরজা বন্ধ হয়ে যায়।

পা চলে না, সরমাকে তবু চলতে হবে। পিছনে দরজা বন্ধ, তবু কেন বলা যায় না ফিরে-ফিরে সে সেদিকে না তাকিয়ে পারে না। নলিনী তার হাতে কি গুজে দিয়েছে তা সে বুঝতে পারছে। নলিনীর সধবা অবস্থার এটি একটি সােনার হার। এটির দিকে তাকিয়ে তার চোখের জল আর বাধা মানতে চায় না। বেশিদুর তাকে অবশ্য যেতে হয় না। গাড়ি নিয়ে নরেন কাছেই দাঁড়িয়ে আছে, দেখা যায়। যন্ত্রচালিতের মতাে সরমা নরেনের হাত ধরে গাড়িতে ওঠে। নরেন কখন পাশে এসে বসে, কখন গাড়ি চলতে শুরু করে, কিছুই সে টের পায় না। 

কল্যাণের হােক, অকল্যাণের হােক, দুটি নরনারীকে এই অনির্দিষ্ট জীবনের যাত্রা-পথে পাঠিয়েই গল্প সমাপ্ত করা যেত; কিন্তু তা হবার নয়। সরমাকে একেবারে ভেস্তে দেবার জন্য তখনও ভাগ্যদেবতার হাতে এমন অপ্রত্যাশিত নিষ্ঠুর চাল ছিল কে জানত! ছেকরা গাড়ি শীতের রাত্রিতে নিস্তব্ধ পথ মুখরিত করে অলস-মন্থর গতিতে চলতে থাকে। পাশাপাশি বসে থেকেও সরমা ও নরেনের মনে হয় যেন তারা কোনাে দুর্লঙ্ঘ্য সাগরের দুই তীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। হঠাৎ সরমা একটু নড়ে চড়ে বসে। নরেন বলে, “তােমার কষ্ট হচ্ছে সরমা?” “না, কিন্তু তােমার পকেটে কি আছে, গায়ে একটু যেন ফুটল।”

আরও পড়ুনঃ Bengali Funny Jokes

চলতি পথে রাস্তার গায়ে গ্যাসের আলাে গাড়ির ভেতরে এসে পড়েছে। নরেন পকেট থেকে যা বার করে তা দেখতে পেয়ে সরমা চমকে উঠে বলে, “এ কি! এ-খেলনা কেন?” নরেন একটু লজ্জিত হয়ে বলে, “ছেলেটার জন্যে কাল কিনেছিলাম, পকেটেই রয়ে গেছে।” সরমা নিশ্বাস রােধ করে অস্পষ্টস্বরে জিজ্ঞাসা করে “কার জন্যে বললে, তােমার ছেলে-মেয়ে আছে?” নরেন হেসে বলে, “বাঃ, তা জানতে না!” সরমা অস্পষ্ট স্বরে জিজ্ঞাসা করে “তােমার স্ত্রী?” নরেন একটু হেসে বলে, “সে তাে দেশে।” সর্পদষ্টের মতাে গাড়ির ভেতর থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সরমা তীক্ষ্ণস্বরে বলে, “গাড়ি থামাও।” নরেন অবাক হয়ে বলে, “কেন, পাগল হলে নাকি?” “থামাও বলছি, শিগগির!” সরমার কণ্ঠস্বর অস্বাভাবিকরকম তীক্ষ। 

নরেন তাকে জড়িয়ে ধরে বসবার চেষ্টা করে বলে, “কি পাগলামি করছ! তুমি এসব জানতে না নাকি?” সরমা উন্মত্তের মতাে তার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে বলে, “জানতাম মানে? “বাঃ! পিসিমার কাছে শােনােনি!” “পিসিমার সঙ্গে এই কি আমার আলােচনার বিষয়! তুমি গাড়ি থামাও!” নরেন কাতর স্বরে বলে, “কিন্তু তুমি আমাকে ভুল বুঝছ সরমা, আমি তােমায় কি দিতে চাইনি। আমার সব কথা শােনাে আগে!” সরমা রাগে দুঃখে অপমানে কেঁদে ফেলে বলে, “না গাে না, তােমার পায়ে পড়ি। আমি বাড়ি ফিরে যাব, গাড়ি থামাও।” সরমাকে শান্ত করবার সমস্ত চেষ্টা নরেনের নিস্ফল হয়ে যায়। সরমার উত্তেজনা দেখে শেষ পর্যন্ত সে একটু ভীতই হয়ে পড়ে সরমা যেন প্রকৃতিস্থ নয়। একান্ত অনিচ্ছায় সে গাড়ি থামাতে আদেশ দেয়। 

কিন্তু গাড়ােয়ানকে বিদায় দেবার পর সরমাকে আর একবার বােঝাবার চেষ্টা করে ; সে বলে, “সে-বাড়িতে তােমার আর ফেরা অসম্ভব, তুমি বুঝতে পারছ না সরমা!” তারপর একটু থেমে আবার বলে, “তােমাকে সত্যিই আমি ঠকাতে চাইনি ; আমি ভেবেছিলাম, আমার সব কথা তুমি জানাে। আর এসব জেনেও তােমার এত বিচলিত হবার কি আছে সরমা বুঝতে পারছি না। আমাদের অতীত যেমনই হােক না কেন, এখনকার valobasha - ই আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড়াে সত্য নয় কি?” সরমা কোনাে উত্তর না দিয়ে নীরবে চলতে শুরু করে। কোথায় সে যাবে, নিজেই জানে না। পৃথিবীতে কোনাে আশ্রয় আর তার নেই এ-কথা সে বােঝে, তবু তার যাওয়া চাই ; নরেনের কাছ থেকে, তার নিজের কাছ থেকে, সমস্ত পৃথিবীর কাছ থেকে তাকে বুঝি দূরে সরে যেতেই হবে। 

নরেন সঙ্গে-সঙ্গে যেতে-যেতে বলে, “তােমার এ-বিপদের জন্যে আমি দায়ী সরমা! আমায় তুমি অন্তত তার প্রায়শ্চিত্ত করবার অবসরটুকু দাও। আমি শপথ করে বলছি, আমার সঙ্গে গেলে, তােমার অসম্মান হবে না” কিন্তু সরমার থামবার কোনাে লক্ষণ দেখা যায় না। কিছু দূর গিয়ে হঠাৎ ফিরে দাঁড়িয়ে সে উন্মত্তভাবে ব্যাকুল স্বরে বলে, “দোহাই তােমার, আমার সঙ্গে আর এসাে না। একলা গেলে এখনও আমার আশ্রয় মিলতে পারে। আমার সে-পথও নষ্ট করে দিয়াে না!” এর পর নরেনের পক্ষে আর সঙ্গে যাওয়া অসম্ভব। তবুও আর একবার অপরিচিত পথে গভীর রাত্রে একলা হাঁটার বিপদের কথা সে সরমাকে বােঝাতে চেষ্টা করে, কিন্তু সরমা অটল। 

পথ সে চেনে, তার সঙ্গে কারাে যাবার প্রয়ােজন নেই। নরেন আর এগুতে পারে না। ধীরে ধীরে সরমা শীতের কুয়াশায় অদৃশ্য হয়ে যায়। সেদিন শীতের রাত্রে একটি ক্লান্ত কাতর মেয়ে অর্ধোন্মত্ত অবস্থায় কলকাতার নিস্তব্ধ নির্জন পথে-পথে কোথায় সে ঘুরে ফিরেছিল, কেউ তা জানে না। শুধু এইটুকু জানি যে হঠাৎ এক-সময়ে গলির গােলকধাঁধায় ঘুরে-ঘুরে ক্লান্ত হয়ে সে একটি ছােট্ট রেলিং- ঘেরা জমি আবিষ্কার করে। পৃথিবীর সমস্ত দ্বার যখন বন্ধ হয়ে গেছে, তখন এই বিবর্ণ জমিটুকু সরমাকে বহুকালের হারানাে মেয়ের মতাে কোল দিয়ে তার ব্যর্থ জীবনের উপর কুয়াশার যবনিকা টেনে দিয়েছিল।

  (সমাপ্ত)

Prosanta Mondal

Hey Guys My Name Is Prosanta Mondal From Kolkata, India. I Am A Professional Blogger and Creative Content Writer.

Post a Comment

Appreciate Your Valuable Feedback. I Hope You Like Post And Subcribe Our Blog. Please DO NOT SPAM - Spam Comments Will Be Deleted Immediately.

Previous Post Next Post