Bengali Sad Love Story in Bengali Language | অসম্পূর্ণ ভালোবাসা

WhatsApp Channel Follow Now
Telegram Group Follow Now

Last updated on July 4th, 2023 at 12:50 am

আজকের Bengali sad love story টির নাম – “আমরা তিন প্রেমিক ও ভুবন” গল্পের প্রধান চরিত্রে ভুবন ও শিবানী, গল্পের বিষয় – অসম্পূর্ণ ভালোবাসা, Valobashar golpo এবং Bangla funny jokes আরও পড়ার জন্য আমাদের ব্লগ টিকে সাবস্ক্রাইব করে আমাদের সাথে থাকুন, গল্পটি পড়িয়া যদি আপনার ভালো লাগিয়া থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট এবং শেয়ার করিতে ভুলিবেন না।

Bengali sad love story in Bengali language

Sad Love Story in Bangla – অসম্পূর্ণ ভালোবাসা

আজকের গল্প – আমরা তিন প্রেমিক ও ভুবন


নদীর চরায় শিবানীর চিতা জ্বলছিল। আমরা তিন বিগতযৌবন বন্ধু শিমুলগাছের তলায় বসে ছিলাম। ফাল্গুনের শেষ, উল্টো টান ধরে গিয়েছিল দুপুরে। রােদ পাখা গুটিয়ে নিতে শুরু করেছে, নদীর বাঁকের মাথায় আকাশে সূর্য হেলে পড়ছিল।

ভুবন গােরুর গাড়ির উপর বসে, গাড়িটা অর্জুন গাছের ছায়ায় দাঁড় করানাে, গােরু দুটো গাছ-গাছালির ফাঁকে শুয়েছিল। শিবানীর মুখাগ্নি শেষ করে ভুবন খানিকক্ষণ চিতার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল, রােদ আর আগুনের ঝলসানি গায়ে মাখেনি, তারপর গাড়িতে গিয়ে বসেছে। হাঁটুর ওপর মাথা রেখে মুখ আড়াল করে সে বসে ছিল, কদাচিৎ মুখ তুলছিল, তুলে শিবানীর চিতা দেখছিল।

চিতার কাছাকাছি, নদীর ভাঙা পাড়ের আড়ালে চার-পাঁচটি ছেলে-ছােকরা আর নিত্যানন্দ। তারা মাথায় গামছা বেঁধে, ভিজে তােয়ালে মুখে ঘাড়ে বুকে বুলিয়ে শবদাহের তদারকি করছিল। পুরুতমশাই আর ছােটকিলাল অনেকটা তফাতে, মাটির কয়েকটি সরা ও কলসি সামনে নিয়ে গাছের ছায়াতে ছাতা খুলে বসে আছে।

আমরা মাঝ-দুপুরে এসেছি। তখন চতুর্দিকে ধু ধু করছিল। গরম বাতাস গায়ে মুখে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছিল। এতক্ষণে যেন সব ক্রমশ জুড়িয়ে আসার মতন ভাব হয়েছে। বালি ভরা নদীর তাপ মরে আসছিল, শীর্ণ জলের ধারাটি শিবানীর চিতার পাশ দিয়ে বয়ে যেতে যেতে কদাচিৎ বাতাসে কিছু শীতলতা ছড়িয়ে দিচ্ছিল।

আমরা তিন বিগতযৌবন বন্ধু শিমুলতলায় বসে শিবানীর সৎকার প্রত্যক্ষ করছিলাম। সিগারেটের টুকরাে দূরে ছুঁড়ে দিয়ে অনাদি বলল, ‘শেষ হতে হতে বিকেল পড়ে যাবে। বলে সে শিবানীর চিতার দিকে তাকিয়ে থাকল।

কমলেন্দু পা ছড়িয়ে আধশােয়া হয়ে বসে ছিল, সে আস্তে আস্তে মাটিতে পড়ল, আকাশ মুখাে হয়ে বােধহয় শিমুলের ফুল দেখবে।

আমি আর-একবার ভুবনের দিকে তাকালাম। ভুবন কুঁজো হয়ে বসে, হাঁটুর ওপর মাথা, দু’হাতে মুখ আড়াল করা। অনেকক্ষণ সে ওই একইভাবে বসে আছে। তার পক্ষে এটা স্বাভাবিক, শিবানী ওর স্ত্রী। তবু আমার মনে হল, ভুবনের এতটা শােকাভিভূত হওয়া ভাব ভালাে দেখাচ্ছে না। সে জোর করে তার শােকের মাত্রার গভীরতা দেখাতে চাইছে। এতটা শােক পাবার কারণ তার নেই। তবু এই শােক কেন? সে কি আমাকে ঈর্ষান্বিত করতে চায়? কিংবা আমাদের তিনজনকেই?

কথাটা আমার এখন বলা উচিত নয় বুঝতে পেরেও যেন ভুবনের শােকে খুঁত ধরাতে বললাম, ‘শিবানীর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছে মাসখানেক আগে। ভুবনের ওপর কি জন্যে যেন রেগে ছিল। ওর শরীর স্বাস্থ্যের কথায় দুঃখ করছিল…

আমার কথায় অনাদি মুখ ফিরিয়ে ভুবনের দিকে তাকাল। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে শেষে, অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘আমরা বােধহয় না এলেই ভালাে করতাম। আমরা চুপচাপ অনাদির কথাটা ভাবছিলাম। সবুজ একটা বুনাে পাখি চিকির-চিক করে ডাকতে ডাকতে চোখের পলকে আমাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলে গেল। কমলেন্দু সব জেনেশুনে বুঝে হঠাৎ বলল, “কেন? আমরা না এলে কি ভালাে হত?

অনাদি ধীরস্থির প্রকৃতির, আস্তে আস্তে নীচু গলায় সে কথা বলে। সামান্য অপেক্ষা করে সে বলল, ‘ভুবন হয়তাে অস্বস্তি বােধ করছে। ঠিক এ সময়ে সে বােধহয় আমাদের বাদ দিয়েই তার স্ত্রীকে ভাবতে চেয়েছিল।

‘ভাবুক, কে তাকে বারণ করেছে’ খানিকটা অবহেলা, খানিকটা উপহাসের গলায় আমি বললাম।

অনাদি আমার দিকে তাকাল। আমরা ওর চোখের সামনে বসে থাকলে ভুবনের পক্ষে আমাদের বাদ দিয়ে শিবানীকে ভাবা মুশকিল।

কমলেন্দু শুয়ে শুয়ে বলল, ‘বেশ তাে, তা হলে সাত-সকালে লােক দিয়ে আমাদের বাড়িতে শিবানীর মারা যাবার খবর পাঠানাে কেন! না পাঠালেই পারত। কিংবা বলে দিলেই পারত আমরা যেন না আসি, আমি বললাম।

খবর না দিলে খারাপ দেখাত, বােধহয় ভদ্রতা করে…

‘আমরাও ভদ্রতা রক্ষা করেছি। শিবানী আমাদের বন্ধুর স্ত্রী, তার সৎকারে না আসাই কি ভালাে দেখাত! কমলেন্দু বলল।

‘বন্দুর স্ত্রী শুধু কেন, শিবানী আমাদের… কি বলব… বান্ধবী, যাই বলাে… সেও তাে আমাদের কিছু একটা ছিল। সে মারা গেছে, আমরা শ্মশানে আসব না? আমি বললাম। অনাদি আর কথা বাড়াল না। পকেট হাতড়ে আবার সিগারেট বের করল। আমাদের দিল। নিত্যানন্দ চিতার কাছে গিয়ে খোঁচাখুঁচি করতে কাঠ ফেটে শব্দ হল। সে চেঁচিয়ে কি যেন বলল, তার সহচর দুটি ছেলে তার কাছে গেল। ভুবন মুখ তুলে চিতার দিকে তাকিয়ে আছে। চিতার ওপর কয়েকটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ যেন আতসবাজির মতন বাতাসে উড়ে ফেটে গেল, সামান্য ছাই উড়ল। একটি ছেলে কয়েকটি কাঠের টুকরাে চিতায় ফেলল।

ভুবন চিতার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে উদাসভাবে নদী আকাশ আর জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর এক সময় আমাদের দিকে মুখ ফেরাল। আমাদের মধ্যে দূরত্ব সত্ত্বেও আমার সঙ্গে তার চোখাচোখি হল। ভুবন মুখ ফিরিয়ে নিল; নিয়ে হাঁটুর ওপর কনুই রেখে গালে হাত দিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকল। ওর এই ভঙ্গি আমার ভালাে লাগছিল না। মনে হল, আমাদের যেন সে আর দেখতে পারছে না! বা দেখেও দেখতে চাইছে না- উপেক্ষা করছে।

বাড়াবাড়ি দেখলে আমার রাগ হয়, ভুবনের এতটা বাড়াবাড়ি দেখে আমার কেমন রাগ আর বিরক্তি হচ্ছিল। আতিশয্য কেন? আমরা কি জানি না শিবানীর সঙ্গে ভুবনের সম্পর্ক কি ছিল? তবে? তবু ভুবন এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন আমরা কিছু জানি না, য়েন শিবানী তার সর্বস্ব ছিল, শিবানীর মৃত্যুতে তার বিশ্বভুবন অন্ধকার হয়ে গেছে!

দুঃখের মধ্যেও আমার হাসি পাচ্ছিল। ভুবনের বােকামির শেষ নেই। তুমি যে কাকে এত শােক দেখাচ্ছ ভুবন, তবু যদি শিবানীর ভালােবাসা পেতে! শিবানী তােমায় ভালােবাসেনি, যদিও শেষ পর্যন্ত তােমায় বিয়ে করেছিল। তুমি স্বামী হয়েছিলে বলে যা পাবার পেয়ে গেছ, তা ভেব না। বরং শিবানীর ভালােবাসা বলতে যা, তা আমি পেয়েছিলাম।

ফাল্গুনের দমকা বাতাস এলাে দক্ষিণ থেকে নদীর তপ্ত বালির ওপর দিয়ে। ঘূর্ণি তুলে ঘােলাটে বাতাস নাচতে নাচতে জঙ্গলের দিকে চলে গেল। ভুবন আবার হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে হাত আড়াল করে বসল যেন সে কাঁদছে।

ভুবনের এত আতিশয্য আর আমার সহ্য হচ্ছিল না। অনাদি আর কমলেন্দুকে বললাম, আমরা একটু আড়ালে গিয়ে বসি না হয়—’ বলে উপহাসের গলায় মন্তব্য করলাম, ‘ভুবনবাবুর আমাদের হয়তাে সহ্য হচ্ছে না, অনাদি যা বলল। কমলেন্দু শিমুল ফুল দেখছিল, নাকি আকাশ, কে জানে! সে বলল, ‘তাতে যদি ভুবন শান্তি পায় আমার আপত্তি নেই। আমার বরং শিবানীর চিতার কাছে বসে ওদিকে তাকিয়ে থাকতে খুব খারাপ লাগছে।

‘তাই বুঝি শুয়ে আছ, আকাশ দেখছ?

কমলেন্দু জবাব দিল না।

অনাদি এবার বলল, ‘আমারও কেমন অস্বস্তি লাগছে। একটু আড়ালে দূরে গিয়ে বসাই ভালাে। তাছাড়া এবার এদিকে রােদ ঘুরে গেছে, বসে থাকা যাবে না। আমরা আরাে অল্পক্ষণ বসে থেকে শিমুলতলা ছেড়ে উঠে পড়লাম। তারপর তিন বন্ধু শিবানীর চিতা এবং ভুবনের দৃষ্টি থেকে সরে অন্য দিকে চলে যেতে লাগলাম। খানিকটা দূরে এসে আমরা বসলাম। এখানে ঘন ঝােপঝাড় আর ছায়া, মাথার ওপর নিমগাছ, সামনে কুলঝােপের ওপর দিয়ে নদী দেখা যায়। মাঝে মাঝে পাখির ডাক ছাড়া আর কিছু কানে যাচ্ছে না। নদীর বালি ছাড়া আর অন্য কিছু চোখেও পড়ছে না। এখানে যে যার মতন আরাম করে বসলাম, বসে নিশ্চিন্ত হলাম। কিছুক্ষণ আমাদের মধ্যে ছােটোখাটো দু-চারটি কথার বিনিময় হল; শিবানী এভাবে, আচমকা একটা অসুখে মারা যাওয়ায় আমরা দুঃখিত। শেষে আমরা একে একে কেমন নীরব হয়ে গেলাম। নদীর দিকে অপরাহ্নের স্তিমিত ভাব নামছিল। আমরা তিনজনেই কখনাে নদী, কখনাে শূন্যতা, কখনাে গাছপালা, কখনাে পায়ের তলায় ঘাস-মাটি দেখছিলাম এবং পরিপূর্ণ নীরব হয়ে গিয়েছিলাম।

আরও পড়ুনঃ গল্পঃ জতুগৃহ 

অনেকক্ষণ এইভাবে বসে থাকার পর হঠাৎ কমলেন্দু কেমন যেন নিশ্বাস ফেলল। দীর্ঘনিশ্বাস নয়, তার চেয়েও যেন গভীরতাপূর্ণ কিছু; তার নিশ্বাসের শব্দে আমরা ওর দিকে সচকিত হয়ে তাকালাম।

কমলেন্দু সুপুরুষ। তার মুখ এখনাে দু-মুহূর্ত তাকিয়ে দেখার মতন। লম্বা ধরনের মুখ, রঙ ফরসা, নাক এবং চোখ বেশ তীক্ষ। তার ফরসা সুন্দর মুখে আমরা কোথায় যেন এক বেদনা দেখতে পেলাম।

অনাদি বলল, “কি হল?

কমলেন্দু অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত, তারপর আমাদের দিকে তাকাল। শেষে বলল, না, কিছু নয়।… কই, দেখি একটা সিগারেট…

পকেট থেকে আমার সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে ওকে দিলাম। নিজে একটা সিগারেট নিয়ে ও আমাদের দু’জনকে দুটো সিগারেট ধরিয়ে অনেকটা ধোঁয়া গলায় নিল। তারপর আমাদের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এ দিকটায় পালিয়ে এসে ভালােই হয়েছে। সামহাউ, আমার শিবানীর চিতার সামনে বসে থাকতে ভালাে লাগছিল না।

হতে পারে, তখন আমি বােকা ছিলুম, বয়স কম ছিল! তবু এ কথা তাে ঠিক, শিবানী আমাকে ভালােবেসেছিল। আমার চেয়ে বেশি সে আর কাউকে কখনাে ভালােবাসেনি?” আমরা তিন বিগতযৌবন বন্ধু পরস্পরের কথা জানতাম এবং ভুবন, আমাদের চতুর্থ বন্ধুও সব জানত। কমলেন্দুর সঙ্গে শিবানীর মেলামেশা ভালােবাসার কথা আমার অজানা নয়; কিন্তু এই মুহূর্তে সে যে দাবীটুকু জানাল তাতে আমার আপত্তি হল। সবচেয়ে বেশি ভালােবাসার কথা উঠলে শিবানীর কাছে আমার চেয়ে আর কেউ বেশি পেয়েছে এ আমি বিশ্বাস করি না। একেবারে সরাসরি না হলেও, কমলেন্দুকে শােনাবার জন্যে, ঠাট্টার একটু গলা করে বললাম, আমার তাে মনে হয়, ওটা আমিই এক সময়ে পেয়েছি।

ধীরস্থির শান্তশিষ্ট মানুষ হলেও অনাদি এখন হঠাৎ কেমন অসন্তুষ্ট ও বিরক্ত হলাে। ঠোট থেকে সিগারেট সরিয়ে বলল, এ-সব তােমাদের মনের ধারণা, কল্পনা। আমার সঙ্গে শিবানীর ঘনিষ্ঠতা এমন সময়ে হয়েছে যখন আমরা দুজনে কেউ বাচ্চা ছিলাম না। সিরিয়াসলি যদি কাউকে সে ভালােবেসে থাকে, আমি সে দাবী সবচেয়ে বেশি করতে পারি।

অনাদির কথায় আমি বা কমলেন্দু, আমরা কেউ খুশী হলাম না। আমাদের কথায় অনাদিও হয়নি। তিনজনে আজ আমরা যে দাবী করছি, সে দাবী ছেড়ে দেওয়া কেন যেন আমাদের সাধ্যাতীত বলে আমার মনে হল। আমাদের তিনজনেরই বয়েস হয়েছে, চল্লিশের এপারে চলে এসেছি। আমাদের তিনজনেরই স্ত্রী আছে, সন্তান আছে। আজ শিবানীর সঙ্গে আমাদের প্রেম নিয়ে অকারণ গল্প করার বা মনােমালিন্য সৃষ্টি করার কোনাে অর্থ ছিল না। তবু, আমরা তিনজনেই এমন এক দাবী জানাচ্ছিলাম যেন সেই দাবী প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে আমাদের কোনাে বিশেষ সুখ ও অহংকার প্রকাশ করা যায় না।

কমলেন্দু ঘন ঘন কয়েকটা টান দিল সিগারেটে, সে অনাদির দিকে এবং আমার দিকে বার বার তাকাল, তারপর সিগারেটের টুকরােটা ফেলে দিয়ে বলল, আমার সঙ্গে শিবানীর ওপর-ওপর মেলামেশা তােমরা দেখেছ; আমি তােমাদের সে-সব গল্পও বলতাম; চিঠিপত্রও দেখিয়েছি; কিন্তু ভেতরে আমাদের কি হয়েছিল তােমরা কি করে জানবে?

‘ভেতরে ভেতরে যা হয়েছে তাও তাে পরে তুই বলেছিস, আমি বললাম।

‘না, আমি সব বলিনি। কিছু না-বলা আছে, সামথিং সিকরেট…’

‘সে-রকম গােপনীয়তা আমারও আছে, কমল। অনাদি বলল।

আমারও গােপনীয়তা ছিল। আমরা তিন বাল্যবন্ধু পরস্পরের কাছে জীবনের কোনাে কিছুই বড় একটা অগােচর রাখতাম না। শিবানীর বেলায়ও কিছু রাখিনি, রাখতে চাইনি, তবু শেষ পর্যন্ত নিশ্চয় কিছু রেখেছিলাম, নয়তাে আজ এ-কথা উঠত না। শিবানীর সঙ্গে মেলামেশার সময়ও আমরা কেউ কারুর প্রতি ঈর্ষান্বিত হইনি। কেন না কমলেন্দু শিবানীর সঙ্গে কৈশােরে ও প্রথম যৌবনে মেলামেশা করেছিল, পরে শিবানীর কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। শিবানীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা একেবারে যৌবনবেলার; আমার সঙ্গে শিবানীর ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর অনাদির সঙ্গে শিবানীর সম্বন্ধ গড়ে উঠেছিল। শিবানীও আমাদের বাল্যকালের বান্ধবী। তার সঙ্গে আমাদের যা যা হয়েছে। তা পরস্পরকে আমরা জানিয়েছি। স্বভাবতই কোনাে ইতর ঈর্ষা আমাদের থাকার কথা নয়, তবু যদি কোনাে ঈর্ষা থেকে থাকে বা হয়ে থাকে তা তেমন কিছু নয়। নয়তাে আমাদের মধ্যে মনােমালিন্য ঘটত এবং আমাদের এই বন্ধুত্ব বজায় থাকত না। এতকাল যা হয়নি তা হওয়া সম্ভব নয়, উচিতও নয়। শিবানীকে নিয়ে কোনাে বিরােধ আমাদের মধ্যে হয়নি; সে জীবিত থাকতে যা হল না, আজ যখন সে আমাদের মধ্যে আর নেই– তখন হবার কোনাে সঙ্গত কারণ থাকতে পারে না।

আমার কি রকম যেন মনে হল। কমলেন্দুর দিকে তাকালাম, তারপর অনাদির দিকে। আমার মনে হল, ওরা নিজেদের গােপনীয়তাকে তাদের প্রতি শিবানীর চরম ভালােবাসার নিদর্শন হিসেবে মনে করছে। আমি নিজেও প্রায় সেইরকম মনে করছিলাম। যদিও আমার আরাে কিছু মনে হচ্ছিল।

কেমন এক অস্বস্তি এবং কাতরতা বশে আমি বললাম, একটা কথা বলব?” ওরা আমাকে দেখল। ‘আমাদের সব কথাই সকলের জানা। ধীরে ধীরে আমি বললাম, আমরা কিছুই লুকোচুরি রাখিনি; তবু আমাদের তিনজনেরই কিছু গােপনতা আছে। আজ সেটা বলে ফেলা কি ভালাে নয়?’ কমলেন্দু অপলকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। অনাদি চোখের চশমাটা ঠিক করে নিল। আমার মনে হল ওরা অনিচ্ছুক নয়।

কমলেন্দু বলল, “বেশ। তাই হােক। কথাটা আজ বলেই ফেলা ভালাে।

অনাদি বলল, ‘আমার কোনাে আপত্তি নেই। কিন্তু শিবানীর চিতা এখন জ্বলছে, আমরা শ্মশানে। এই সময় সে-সব কথা বলা কি ভালাে দেখাবে!’

‘খারাপই বা কি!’ আমি বললাম, আমার বরং মনে হচ্ছে বলে ফেললেই স্বস্তি পাব।’

অনাদি আস্তে মাথা নাড়ল। সে সম্মত।

কমলেন্দুর দিকে আমি তাকালাম। সেই বলুক প্রথমে। শিবানীর জীবনে সে প্রথম প্রেমিক।

‘সব কথা বলার কোনাে দরকার নেই কমল, আমরা জানি। আমরা যা জানি না তুমি শুধু সেইটুকুই বলাে।

কমলেন্দু আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, ‘তাই বলব।

কমলেন্দু বলল ‘তােমাদের নিশ্চয় মনে নেই, আমি একবার মাস দেড়েক কি দুয়েকের জন্যে মােতিহারিতে ছােটকাকার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। ফিরে এলাম যখন, তখন বর্ষার শুরু, আমাদের ম্যাট্রিকের রেজাল্ট আউট হয়ে গেছে। বাবা পাটনায় মেসােমশাইকে আমার কলেজে ঢােকার সব ব্যবস্থা করতে চিঠি লিখে দিয়েছিলেন। পরীক্ষায় আমার রেজাল্ট কি হয়েছিল তােমরা তা জানাে। কলেজে পড়তে যাবার আনন্দে তখন খুব মশগুল হয়ে আছি, বাড়িতে চব্বিশ ঘণ্টা আদরের ঘটা চলছে। শিবানীর সঙ্গে আমার তখন গলায় গলায়। মােতিহারিতে সে আমায় চিঠি লিখত। তার মা-বাবার কথা তােমরা জানাে, পয়সাকড়ি থাকার জন্যে, আর তার বাবা মনােজ কাকা বেভিন-স্কীমে বিলেত ঘুরে আসার পর আরাে একটু সাহেবী হয়ে গিয়েছিলেন। শিবানীকে শাড়ি ধরাতে ওঁরা দেরী করেছিলেন। আমি যখন মােতিহারিতে, তখন শিবানী শাড়ি ধরেছে। চিঠিতে আমায় লিখেছিল। ফিরে এসে দেখলাম, ছিপছিপে শিবানীকে শাড়ি পরে একেবারে অন্য রকম দেখাচ্ছে বেশ বড় হয়ে গেছে বেশ বড়। কই, আর একটা সিগারেট দাও তাে…।

অনাদি কমলেন্দুকে সিগারেট দিল। সিগারেট ধরিয়ে কমলেন্দু কেমন অন্যমনস্ক হয়ে থাকল সামান্য, তারপর বলল: ‘একদিন বিকেলবেলা নাগাদ সাংঘাতিক বৃষ্টি নেমেছিল। যেমন ঝড়, তেমনি বৃষ্টি। এক একটা বাজ পড়ছিল- যেন মনে হচ্ছিল ঘরবাড়ি গাছপালায় আগুন ধরিয়ে ছাই করে দেবে। আর তেমনি আকাশ, পাকা জামের মতন কালাে। দেখতে দেখতে যেন সন্ধে। দোতলায় আমার ঘরে আমি দরজা-জানলা বন্ধ করে বসে। একটা জানলা, যেটা দিয়ে ছাট আসছিল না জলের, খুলে রেখেছিলাম। উলটো দিকে শিবানীদের বাড়ি। শিবানীর মা লতিকা-কাকিমার শােবার ঘরের গায়ে শিবানীর ঘর। আমার ঘর থেকে শিবানীর ঘর দেখা যায়.. কিন্তু খানিকটা দূর। আমরা আমাদের ঘরে বসে বসে জানলায় দাঁড়িয়ে হাত-টাত নেড়ে হাসি-তামাশা করছিলাম। কখনাে কখনাে ঝড়বৃষ্টির মধ্যে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কিছু বলছিলাম, শব্দ বড় একটা পৌছচ্ছিল না। ‘আমি অনেকক্ষণ ধরে শিবানীকে ডাকছিলাম। ইয়ার্কি করেই। তাকে ইশারা করে বলছিলাম শাড়ি পরে মাথায় ঘােমটা দিয়ে চলে আসতে। শিবানী আমায় বুড়াে আঙুল দিয়ে কাচকলা দেখাচ্ছিল। এইরকম করতে করতে একেবারে সন্ধে হয়ে এলাে। পেয়ারা গাছের ডালের পাশ দিয়ে শিবানীর ঘরের অনেকটাই চোখে পড়ে আমার। সে আমায় দেখিয়ে দেখিয়ে জানলায় বসে চুল বেঁধেছে, একটা শাড়ি আলনা থেকে এনে দেখিয়েছে, দূর থেকে রঙটা বুঝতে পারিনি।… সন্ধের মুখে সব যখন অন্ধকার, আমি নীচে থেকে বাতি আনতে যাব, দরজায় দুমদুম শব্দ। খুলে দেখি শিবানী, হাতে বাতি। সে ওই বৃষ্টির মধ্যে এ বাড়ি চলে এসেছে, নীচে থেকে আসার সময় মা তার হাতে বাতি দিয়ে দিয়েছে। শিবানী এইটুকু আসতেই খানিকটা ভিজে গিয়েছিল; হাত পা মাথা শাড়ির আঁচল বেশ ভিজেছে। লণ্ঠনটা আমার হাতে দিয়ে শিবানী তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিল। জলের ছাট আসছিল। আমি আলনায় ঝুলানাে আমার একটা জামা এনে ওর ভিজে হাত মাথা ঘাড় মুছিয়ে দিতে লাগলাম। ওর মাথার চুল অনেকটা ভিজে গিয়েছিল বলে শিবানী তার লম্বা বিনুনি খুলে ফেলেছিল। ওকে আমি আমার পড়ার টেবিলের সামনে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে ভিজে পা দুটি মুছিয়ে দিতে গেলাম ইয়ার্কি করেই। ও পা দুলােতে লাগল, হাসতে লাগল। শিবানী ততক্ষণে মাথার চুল খুলে ঘাড়ে পিঠে ছড়িয়ে দিয়েছে। তারপর আমরা লণ্ঠনের আলােয় বসে গল্প করতে লাগলাম। শিবানীর গানের মাস্টার ছিল, সে যে এক সময়ে মােটামুটি ভালাে গাইত তা তােমরাও জানাে। শিবানীকে একটা গান গাইতে বললাম। শিবানী যে গানটা গাইল তা আমার এখনাে মনে আছে, আমি অনেকবার সে গান শুনেছি, কিন্তু সেদিনের মতন কখনাে আর নয়। ঝড়-বৃষ্টি, বাইরের দুর্যোগ আর অন্ধকারের মধ্যে আমার ঘরে বসে মিটমিটে লণ্ঠনের আলােয় সে গাইল : ‘উতল ধারা বাদল ঝরে…। ওই গানেরই একটা জায়গা ছিল, ‘ওগাে বঁধু, দিনের শেষে এলে তুমি কেমন বেশে, আঁচল দিয়ে শুকাব জল, মুছাব পা আকুল কেশে….’ বার বার শিবানী ওই চরণ দুটি গাইছিল, আর আমার দিকে তাকিয়ে দুষ্টু করে হাসছিল। অর্থটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম।…গান শেষ হলে আমরা গল্প করতে লাগলাম। এ গল্প সে-গল্প। শেষে আমরা ছেলেমানুষের মতন হাতের রেখা, কপালের রেখা, ভাগ্য, ভবিষ্যৎ এইসব কথা নিয়ে মেতে উঠলাম। একে অন্যজনকে সৌভাগ্যের চিহ্ন দেখাতে ব্যস্ত। হঠাৎ শিবানী বলল, তার বুকের নীল শিরার একটা ক্রুশ চিহ্ন আছে। আমি বললাম, তাহলে সে মস্ত পুণ্যবতী। বলে আমি হাসছিলাম। এরকম যে হয় না, হতে পারে না, তা আমি জানতাম। আমার হাসি দেখে শিবানী বুঝতে পারল আমি তাকে অবিশ্বাস করছি। সে বলল, ‘হাসছ কেন? বিশ্বাস হচ্ছে না? আমি মাথা নাড়লাম, ‘তুমি কি যীশু?’…শিবানীর অভিমানে লাগল। বলল, “আহা, যীশু না হলে বুঝি কিছু থাকতে পারে না? আমি তাকে আরাে রাগিয়ে দিয়ে বললাম, “যার কোথাও পাপ নেই, তার থাকতে পারে…। মানুষের নয়। যীশুর মতন তুমি মরতে পারবে?’…শিবানী কি ভাবল জানি না, হঠাৎ সে তার বুকের জামার ওপরের বােতাম খুলে জামা অনেকটা সরিয়ে আমায় বলল ‘আলাে এনে দেখ।… আমি দেখলাম। কি দেখলাম। কি দেখলাম তা তােমাদের কাছে বলে লাভ নেই।..বুঝতে পারছ। তবে শিবানীর বুকে শিরা ছিল, নীলচে রঙের। সেটা ক্রশ কি না আমি দেখিনি। অন্য জিনিস দেখছিলাম। আজ আমার স্বীকার করতে দোষ নেই, সেই বয়সে শিবানীর সেই ইনােসেন্স ছিল। আমার হাতে সেটা মরে গেল।

আরও পড়ুনঃ Latest Bengali Jokes for Whatsapp

কমলেন্দু নীরব হল। তাকে অন্যমনস্ক ও অপরাধীর মতন দেখাচ্ছিল। নদীর চরের ওধারে রােদ সরে যাচ্ছে, তাপ অনেকটা কমে এসেছে, কোথাও একটা কাক ডাকছিল, গাছের পাতায় বাতাসের সরসর শব্দ হচ্ছিল। কেমন যেন একটা নিঃঝুম ভাব।

আমরা তিন বন্ধু নিশ্বাস ফেললাম। কমলেন্দু রুমালে মুখ মুছে নিল। অনাদি আমার দিকে তাকাল। শিশির, তােমার যা বলার…

আমার বলার পালা কমলেন্দুর পর। শিবানীর জীবনে আমি দ্বিতীয় প্রেমিক, তার যৌবনের প্রেমিক। আমারও তখন যৌবন। আমাদের তখনকার ঘনিষ্ঠতার কথা কমলেন্দুর অজানা নয়। ওরা যা জানে না, ওদের কাছে আমি যা গােপন রেখেছিলাম, এবার তা বলার জন্যে আমি তৈরি হলাম। কুলঝােপের মাথা ডিঙিয়ে অপরাহ্নের রােদ এবং নদী দেখতে দেখতে আমি গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললাম, আমি খুব সংক্ষেপে সারতে চাই।” ‘শুনি…’ কমলেন্দু বলল।

‘বলছি…। তােমাদের কাছে কোনাে ভূমিকার দরকার নেই। তবে তােমাদের জানা দরকার, যে তিন-চার বছর শিবানীর সঙ্গে আমার খুব মাখামাখি ছিল এটা তার শেষের দিকের ঘটনা—’আমি ধীরে ধীরে বললাম। “শিবানীর বাবা তখন মারা গেছেন, লতিকা কাকিমারা তাদের নতুন বাড়িতে থাকেন। আমি আবার ইলেকট্রিক্যাল অ্যাপ্রিনটিসশিপ শেষ করে পাওয়ার হাউসে চার্জে রয়েছি। শিবানীর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা তখন এমন অবস্থায় যে, তােমরাও ভাবতে, আমি তাকে বিয়ে করব। লতিকা কাকিমাও ভাবতেন। শিবানীরও তাতে সন্দেহ ছিল না। সন্ধেবেলা ওদের বাড়ি গিয়ে আমাকে তখন বাইরে বারান্দায় অপেক্ষা করতে হত না, সােজা ড্রয়িংরুমের পর্দা সরিয়ে বাঁদিকের দরজা দিয়ে শিবানীর শােয়ার ঘরে চলে যেতে পারতাম। গল্পগুজব, গানবাজনা, খাওয়াদাওয়া সেরে যখন বাড়ি ফিরতাম তখন রাত হয়ে যেত। শিবানী আমায় ফটক পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যেত। আর প্রায় রােজই ফেরার সময়, ফটকের করবী ঝােপের আড়ালে দাঁড়িয়ে সে আমায় চুমু খেত।..শিবানীকে যে দেখতে সুন্দর ছিল, তা আমার কখনাে মনে হয়নি। তার গায়ের রঙ, চোখমুখের ছাঁদ আমার পছন্দ ছিল না। কিন্তু তার শরীর আমার ভীষণ পছন্দ ছিল, তাদের বাড়ির আবহাওয়ায় যে স্বাধীনতা, সপ্রতিভ ভাব, খােলামেলা আচরণ ছিল, তাও আমার খুব পছন্দ ছিল। নতুন ধরনের রুচি, পরিচ্ছন্নতা, বেশবাসের সৌন্দর্য।…এ-সবের জন্যে, আর শিবানীর তখনকার শরীরের জন্যে তাকে আমার ভালাে লাগত। শিবানীর সেই যৌবন বয়সে তােমরা জানাে, মনে হত তার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেন ফেটে পড়ছে।…একদিন, সেটা শীতকাল, লতিকা কাকিমা তাঁদের মহিলা সমিতির মিটিঙে গিয়েছিলেন। বাড়িতে চাকর আর ঝি ছিল। ঝি-টার ঠাণ্ডা লেগে অসুখ করেছে, সে শুয়ে আছে। শিবানীর শােবার ঘরে বসে আমরা গল্প করছিলাম। জানুয়ারি মাস, প্রচণ্ড শীত। ঘরের জানলা-টানলা সবই বন্ধ ছিল।…সাধারণ একটা কথা নিয়ে আমরা দুজনেই হাসছিলাম, হাসতে হাসতে শিবানী বিছানায় গিয়ে লুটিয়ে পড়ল। সে এমনভাবে পড়েছিল যে তার একটা হাত মাথার ওপর দিয়ে বালিশে পড়েছে, অন্য হাতটা তার কোমরের কাছে বিছানায় অলসভাবে পড়ে আছে, তার মুখ সিলিংয়ের দিকে, মাথার ওপর হাত থাকার জন্যে তার বুকের একটা পাশ আরাে স্ফীত হয়ে উঠেছে। শিবানীর কোমরের তলা থেকে পা পর্যন্ত বিছানা থেকে মাটিতে ধনুকের মতন বেঁকে কিংবা বলা ভালাে ঢেউয়ের মতন ভেঙে পড়েছে। বিছানার ওপর সুজনিটা ছিল কালচে-লাল, তাতে গােলাপের মতন নকশা; শিবানীর পরনের শাড়িটা ছিল সিল্কের, তার রঙ ছিল। সাদাটে। ওর ভাঙা শরীরের বা আছড়ে পড়া শরীরে দিকে তাকিয়ে আমার আত্মসংযম নষ্ট হয়ে গেল। ঘরের বাতি নিবিয়ে দিয়ে আমি যখন তার গায়ের পাশে, সে আমায় যেন কেমন করে ফিসফিস গলায় গরম নিশ্বাসের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, আমি কবে তার মাকে কথাটা বলব।…আমি তখন যে-কোনাে রকম ধাপ্পা দিতে রাজী। বললাম, কালই বলব, কাল পরশুর মধ্যে। শিবানী যেন অন্ধকারের মধ্যে সুখে আনন্দে উত্তাপে সর্বাঙ্গে গলে যেতে শুরু করল।… সে কতবার করে বলল, সে আমায় ভালােবাসে। আমি কতবার করে বললাম আমি তাকে ভালােবাসি।…তারপর ঘরের বাতি জ্বালা হয়ে গেলে আমি শিবানীর ময়লা রঙ, ছােট্ট কপাল, মােটা নাক, সামনের বড় বড় দাঁত, পুরু পুরু ঠোটের দিকে তাকিয়ে মুখ নিচু করে পালিয়ে এলাম।তারপর থেকেই আমি পালিয়েছি…

আমি থেমে গেলাম। আমার গলার কাছে একটা সীসের ডেলা জমে গিয়েছে। চোখ ফেটে যাচ্ছিল। কী যে অনুশােচনা আজ, কেমন করে বলব!

নদীর ওপারে বনের মাথায় রােদ চলে গেছে। ছায়া পড়ে গেছে নদীর চর জুড়ে। শরীর খারাপের অজুহাতে আমি ছুটি নিয়েছি, পুজোর মুখে। আমার বাড়ি বলতে এক মা, বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় তুলেই দিয়েছিলাম। ছুটি নিয়ে শিবানীদের বাড়িতে পড়ে আছি। দুশ্চিন্তায় খাওয়া নেই, ঘুম নেই চোখ-মুখ শুকিয়ে হলুদ হয়ে গেছে। এমন সময় একদিন বিকেল থেকে লতিকা-মাসিমার খুব বাড়াবাড়ি অবস্থা হল। ডাক্তার ডেকে আনলাম, ওষুধপত্র চলতে লাগল নতুন করে।…সেদিন সন্ধের পর লতিকা মাসিমার অবস্থা যখন একটু ভালাে হল, আমি বাইরে- শিবানীদের বাড়ির বাগানে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, অন্ধকারে। এমন সময় কখন শিবানী পাশে এসে দাঁড়াল। দু’চারটে কথার পর সে বলল, আমি আর কতদিন এভাবে দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনা নিয়ে বসে থাকব?’..আমি তখন জামিন এবং টাকার কথা বললাম। শিবানী কিছু না ভেবেই বলল লতিকা মাসিমার কাছে সে বলবে।..আমরা দুজনেই তখন একটা শিউলিগাছের কাছে। দাঁড়িয়েছিলাম, অনেক দিন পরে হঠাৎ আমার নাকে শিউলি ফুলের গন্ধ লাগল। আমি

শিবানীর হাত টেনে নিয়ে কৃতজ্ঞতায় কেঁদে ফেললাম। আমার সেই কান্না কুকুরের মতন। শিবানী আমায় সান্ত্বনা দিল। পরে বলল, এই ঘরবাড়ি টাকা— এ-সব মা আমার ভবিষ্যৎ ভেবে রেখেছে। যার কাছে আমার আশ্রয় জুটবে এ-সবই তার। তুমি তাে এ সবই তােমার নিজের ভাবতে পার। আমি সে-রাত্রে অনেকটা নিশ্চিন্ত হলাম।…লতিকা মাসিমা আমার তরফে জামিন দাঁড়ালেন, কিছু টাকাও আমায় তিনি দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত মহেশ্বরী মামলায় এমন এক অবস্থায় পড়ল যে তাকে সরিয়ে রাখা টাকা বের করে দিতে হল। আমার গণ্ডগােলটাও মিটে গেল। লতিকা মাসি অবশ্য আরাে মাস কয়েক বেঁচে ছিলেন। কিন্তু শিবানী ভবিষ্যতের জন্যে আমার উপর নির্ভর করতে চেয়েছিল; সে-ভার আমি নিইনি, তাকে আশ্রয়ও দিইনি। শিবানীকে ঠিক বিয়ে করার মতন মেয়ে আমার কোনােদিনই মনে হয়নি।..

অনাদি চুপ করল।

আমরা চুপচাপ। নিঃসাড় যেন। একটা সাদা ধবধবে বক নদীর ওপর দিয়ে গােধূলির আলাের সীমানা পেরিয়ে কোথায় যেন চলে গেল।

কমলেন্দু বলল, লতিকা কাকিমার টাকাটা তুমি ফেরত দাওনি?”

‘পরে মাসিমা মারা যাবার পর শিবানীকে কিছুটা দিতে গিয়েছিলাম, ও নেয় নি। আর কোনাে কথা হল না। আমরা তিন বিগতযৌবন বন্ধু, শিবানীর তিন প্রেমিক-পুরুষ নীরবে বসে থাকলাম, কেউ কারাে দিকে তাকালাম না। বসে বসে কখন যেন দেখলাম, আকাশ বন নদী জুড়ে আসন্ন সন্ধ্যার ছায়া। আমাদের চারপাশে সেই সীসের মতন ছায়া ক্রমশই জমতে লাগল। আমাদের নাম ধরে চিতার কাছ থেকে ওরা ডাকছে। দাহ শেষ। চিতা ধুয়ে দেওয়া হচ্ছে। ছেলেগুলাের জল ঢালা ফুরােলাে। এবার নদী থেকে মাটির কলসিতে জল ভরে এনে কমলেন্দু শিবানীর ভিজে চিতায় ঢেলে দিল। তারপর আমি। কমলেন্দুর হাত থেকে কলসি নিয়ে নদী থেকে জল ভরে আনলাম। এনে শিবানীর চিতায়, তার নিশ্চিহ্ন শরীরের ছাইয়ের রাশিতে জল ঢাললাম। তারপর অনাদি জল দিল। শেষে ভুবন।

আরও পড়ুনঃ রহস্যময়ী 

কলসিটা ভেঙ্গে দিয়ে ভুবন ফিরল। আমরা কেউ আর পিছু ফিরে তাকাব না। আমরা এগিয়ে চলেছি। ওরা পুরুতমশাই আর ছেলেরা আমাদের আগে আগে, গােরুর গাড়িটা চলছে, চাকার করুণ শব্দ, আমরা চার বন্ধু পাশাপাশি। ভুবনকে আমাদের পাশে পাশে হেঁটে যেতে দেখে আমাদের অস্বস্তি হচ্ছিল। ও বড় ক্লান্ত, অবসন্ন। মনে হল যেন ঠিক মতন পা ফেলতে পারছে না। আমরা তাকে গােরুর গাড়ির ওপর বসিয়ে দিলাম জোর করে। সে আমাদের দিকে মুখ করে গােরুর গাড়িতে বসে থাকল, উদাস দৃষ্টিতে।

এমন সময় চাঁদ উঠে গেল। শুক্লপক্ষ, আজ বুঝি ত্রয়ােদশী।

নদী পিছনে, দু’পাশের জঙ্গল গুটোনাে পাখার মতন দু’পাশে নেমে গেছে, সামনে উঁচু-নীচু কাঁচা রাস্তা। জ্যোৎস্না ধরেছে বনে, ঝিল্লিরব ঘন হয়ে এলাে, ফাল্গুনের বাতাস বইছে, গােরুর গাড়ির চিকন করুণ শব্দ ছাড়া আর শব্দ নেই, আর আমাদের পায়ের শব্দ। মাথার ওপর চাঁদ।

যেতে যেতে কমলেন্দু হঠাৎ বলল ভারী গলায়, ‘শিবানীর চিতায় জল ঢালার সময় কেমন যেন কান্না এসে গিয়েছিল। আহা, বেচারী। ভাই, আমি আজ তার কাছে, তার চিতায় জল দেবার সময়, মনে মনে ক্ষমা চেয়েছি।

অনাদি যে কাঁদছিল আমরা খেয়াল করিনি। সে ছেলেমানুষের মতন মুখে কান্না ও লালা জড়িয়ে বলল, ‘আমিও…’

চাঁদের আলােয় আমরা তিন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তিন প্রেমিক চলেছি। আমাদের সামনে ভুবন। পিছনে শ্মশান, শিবানীর ধুয়ে যাওয়া চিতা।

যেতে যেতে সামনে ভুবনের দিকে তাকিয়ে আমি ভাবছিলুম, আমরা তিনজন তিন প্রেমিক শিবানীর নিস্পাপতা, কৌমার্য, নির্ভরতা তাে হরণ করে নিয়েছিলাম। নিয়ে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছি। কিন্তু তারপরেও আর কি অবশিষ্ট ছিল শিবানীর, যা ভুবন পেয়েছে। কি পেয়েছে ভুবন, যার জন্যে তার এত ব্যথা? চাঁদের আলােয় ভুবনকে কেমন যেন দেখাচ্ছিল। তার চারপাশে নিবিড় ও নীলাভ, স্তব্ধ, মগ্ন যে চরাচর তা ক্রমশই যেন ব্যাপ্ত ও বিস্তৃত হয়ে এক অলৌকিক বিষন্ন ভুবন সৃষ্টি করেছিল। এ যেন আমাদের ভুবন নয়। অথচ আমাদেরই ভুবন।

ফাল্গুনের বাতাস দিচ্ছিল। ঝাক বেঁধে পাখিরা উড়ে আসতে শুরু করেছে। সমস্ত জায়গাটা অপরাহ্নের বিষন্নতার ক্রমশই মলিন হয়ে আসছে।

আমাদের তিন বন্ধুর নিশ্বাস পড়ল।

আমি সিগারেটের প্যাকেট বের করলাম। মুখ মুছলাম। তিনজনে সিগারেট ধরিয়ে নিলাম। এবার অনাদির পালা। শিবানীর তৃতীয় প্রেমিক। অনাদির দিকে তাকালাম। অনাদি প্রায় আধখানা সিগারেট শেষ করল, কোনাে কথা বলল না। শেষে মাটির দিকে তাকিয়ে তার কথা শুরু করল ।

‘শিবানীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা যখন হয়েছে তখন আমরা কেউ বাচ্চা নেই। আমার বয়স তেত্রিশ পেরিয়ে গিয়েছিল, শিবানী প্রায় তিরিশ। লতিকা মাসিমা তখন আর ঠিক বেঁচে থাকার মতন অবস্থায় নেই। সেই আরথারাইটিসের অসুখে পঙ্গু, শয্যাশায়ী। আমি ব্যাংকে অ্যাকাউন্টেন্ট হয়েছি নতুন… তােমরা ভাই জানাে, মহেশ্বরী যখন কনট্রাকটারী ব্যবসায় নামল, তখন আমি তার পেছনে ছিলাম, তার সঙ্গে আমার ভেতরে ভেতরে কথা ছিল, তার লাভের একটা পার্সেন্টেজ আমায় দেবে, আমি ব্যাংকে তার সবরকম সুবিধে করে দেবাে। প্রথম প্রথম মহেশ্বরীর কাছ থেকে বেমক্কা দু’চারশাে পেতাম। ব্যাংকে আমি তার সুবিধে-টুবিধের মাত্রাও বাড়াতে লাগলাম। মামা ম্যানেজার, যদিও নিজের মামা নয়। মামাকে আমি নানাভাবে ইনফ্লুয়েন্স করতাম। কিন্তু মহেশ্বরী শেষে আমায় ডুবিয়ে দিল। বিশ্রী এক অবস্থায় পড়লাম। ব্যাপারটা এমন ঘােরালাে হয়ে দাঁড়ালাে যে, আমার পক্ষে কোথাও আর আইনের ফাঁক থাকল না। শিবানীর সঙ্গে তখন আমার মেলামেশা। সত্যি কথা বলতে কি আমার তখন এমন কাউকে দরকার, যে আমার অর্থ সাহায্য করতে পারে। অন্তত একটা জামিন থাকলেও আমার পক্ষে একটু সুবিধে হয়। শিবানীদের নিজের বাড়িঘর, জমি, লতিকা মাসিমার— আমি তাঁকে মাসিমা বলতাম— কিছু টাকা এবং অলংকার ছিল। নিজেকে বাঁচাবার জন্যে শিবানীদের শরণাপন্ন হবার কথা ভাবছিলাম। লতিকা মাসিমা মারা গেলে সমস্ত সম্পত্তিই শিবানীর হবে। তাছাড়া, লতিকা মাসিমা বেঁচে থাকতেও যদি শিবানীর সঙ্গে আমার তেমন একটা সম্পর্ক দেখতে পান, তিনি আমায় বিপদ থেকে পরিত্রাণ করতে পারেন। বেশি বলে লাভ নেই, আমি শিবানীর সঙ্গে যে-ধরনের সম্পর্ক পাতালাম— তাতে মনে হবে আমরা যেন স্বামী-স্ত্রী। আমি শিবানীর অঙ্গ স্পর্শ করিনি মানে সেভাবে নয়, আমার তাতে আগ্রহ ছিল না। অথচ আমি শিবানীদের বাড়িতে সারাদিনও থেকেছি। তাদের বাড়িতে থেকেছি, খেয়েছি, বিছানায় শুয়েছি, লতিকা মাসিমার জন্যে ডাক্তার ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করেছি, শিবানীর ও তাদের সংসারের তদারকি করেছি।…আমার ওপর লতিকা মাসিমার সুনজর পড়ল, শিবানী প্রথম প্রথম আমায় কি ভাবত জানি না, পরে সে আমার ওপর নির্ভর ও বিশ্বাস করতে লাগল। তখন চাকরিতে আমার গণ্ডগােল বেধে গেছে, মামার জোরে তখনাে জেলে যাইনি, কিন্তু মহেশ্বরীকে মামলায় জড়িয়ে পড়তে হয়েছে। 


                                 (সমাপ্ত)

Leave a Comment

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now