Bangla Romantic Love Stories | রোমান্টিক ভালোবাসার গল্প

WhatsApp Channel Follow Now
Telegram Group Follow Now

Last updated on July 4th, 2023 at 12:50 am

আজকের Bangla Romantic Love Stories টির নাম -“নেকী” গল্পের প্রধান চরিত্রে অশোক ও লীলা, বিষয় – রোমান্টিক ভালোবাসা, Bengali Sad Love Story এবং Premer golpo অথবা Bangla Funny Jokes আরও পাওয়ার জন্য আমাদের ব্লগ টিকে সাবস্ক্রাইব করে আমাদের সাথে থাকুন, গল্পটি পড়িয়া যদি আপনার ভালো লাগিয়া থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট এবং শেয়ার করিতে ভুলিবেন না।

Romantic bangla love stories

Bangla Love Stories to Read – রোমান্টিক প্রেমের গল্প


আজকের গল্প – নেকী
পর্ব – প্রথম

পূর্ববঙ্গের মহকুমা শহর।
শহর সন্দেহ নেই, তবে বিশুদ্ধ নয়। গ্রামের খাদ আছে। চারদিকে ঘুরে এলে মনে হয় যেন এ শহর আর গ্রামের আলিঙ্গনবদ্ধ মূর্তি।
বাজার আর আপিস অলটুকু দিব্যি শহর। আপ-টু-ডেট বাজার, কলকাতায় কোনাে নতুন ফ্যান্সি জিনিস উঠলে একমাসের ভেতরে স্থানীয় মনিহারী দোকানগুলিতে আত্মপ্রকাশ করে। একটি মাত্র বাঁধানাে রাস্তা, মাইলখানেক লম্বা,-বাজারের বুক ভেদ করে, আদালতের গা ঘেঁষে গিয়ে মাটির রাস্তায় আত্মগােপন করেছে। বাজারের কাছে ছােট ছােট কয়েকটা শাখাও আছে।




বাজারের কিছু দূরে পাকা রাস্তার ধারে একটি হাইস্কুল। কাছাকাছি পাবলিক লাইব্রেরি, টাউন হল, অফিসারদের ক্লাব, ক্লাব-সংলগ্ন টেনিস-কোর্ট ইত্যাদি। অভাব নেই, কিছুরই। শহর যেমন হয় আর কি।
বাকিটুকু কিন্তু গ্রাম ছাড়া কিছু নয়। বাড়ি-ঘর সবই প্রায় চাচের বেড়া এবং টিনের ছাদ দেওয়া। কোনাে কোনােটার ভিটেটুকু মাত্র পাকা বাঁধানাে। শুধু তাই নয় গ্রামের যা প্রধান প্রধান লক্ষণ, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড আম কাঁঠালের বাগান পুকুর ডােবা ঝােপ-ঝাড় জঙ্গল বেতবন থেকে আরম্ভ করে সাপ, ব্যাঙ, শিয়াল, বেজী এবং টিকটিকির রাজসংস্করণ গােসাপ পর্যন্ত সমস্তই আছে।

শহরের পশ্চিম প্রান্তে আগাগােড়া চুনকাম করা একটি পাকা বাড়ি। বাড়িটা বরাবর স্থানীয় প্রথম মুন্সেফ দখল করে থাকেন। এখন আছেন হেমন্ত মুখার্জী। বাড়িটির পেছনে প্রকাণ্ড এক আম বাগান, তারই এক দিকে ডােবা সংস্করণ একটি পুকুর। এই গল্পের আরম্ভ ওইখানে, একদিন বেলা প্রায় দশটার সময়। ষোল সতের বছরের একটি মেয়ে স্নান করছিল। পুকুরের চারিদিকে প্রকৃতির নিজের হাতে গড়া গাছপালার প্রাচীর। এত ঘন যে আট দশ হাতের ভেতরে বুঝতে পারা যায় না এখানে পুকুর আছে। আশেপাশে বাড়ি-ঘরও বেশি নেই একান্ত নির্জন। মেয়েটির শঙ্কা ছিল না, নিত্যকার মতাে সমস্ত পুকুরটা সাঁতরে এসে নিশ্চিন্ত চিত্তে অঙ্গমার্জনা করছিল। 

হঠাৎ এপারে নজর পড়তে দেখল, বছর বাইশ তেইশের একটি ছেলে, চোখে সােনার চশমা, একটা আমগাছের গুঁড়ি ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। ত্রস্তভাবে নিজেকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত করে দিয়ে মেয়েটি সংযত হয়ে নিল। জড়সড় হয়ে তেমনি গলা পর্যন্ত জলে ডুবে দাঁড়িয়ে রইল। ভাবল, ভদ্রলােকের ছেলে, সরে যাবে। ছেলেটির কিন্তু নড়বার লক্ষণ দেখা গেল না। তেমনিভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। রাগে বিরক্তিতে মেয়েটি ঠোট কামড়ে ধরল। এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে জল থেকে উঠে এল। তারপর ধীরপদে ছেলেটির কাছে এগিয়ে গেল।

ছেলেটি নিবিষ্ট চিত্তে গাছের ওপর কি দেখছিল, যেন পৃথিবীর কোনাে দিকে তার লক্ষ্য নেই!
রাগে গা জ্বলে গেল। তিক্তস্বরে মেয়েটি বললে, দেখুন ছেলেটি চমকে তার দিকে তাকাল।
মেয়েটি বলল, এত দূর থেকে দেখতে আপনার বােধহয় অসুবিধা হচ্ছে, ঘাটের পাড়েই চলুন না? আমার স্নানের এখনাে বাকি আছে।
আমায় বলছেন?
দ্বিতীয় ব্যক্তি তাে কারুকে দেখছি না এখানে। আপনি ভদ্রলােকের ছেলে, আপনার যদি এরকম প্রবৃত্তি- রাগে দুঃখে মেয়েটির কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল। ছেলেটি অকৃত্রিম বিস্ময়ে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল। মেয়েটি আবার বলল, আর একদিন আপনি উকি মারছিলেন, কিছু বলিনি। কিন্তু এ আপনার কোন দেশী ভদ্রতা? আপনার বাধে না, কিন্তু আমরা লজ্জায় মরে যাই। মানুষকে এত নীচ ভাবতেও যে কষ্ট হয়।




বিবর্ণ মুখে ছেলেটি বললে, এসব আপনি কি বলছেন? আমি- ন্যাকামি! ছেলেটির মুখ দেখে মন একটু নরম হয়েছিল, এই ন্যাকামিতে আবার কঠিন হয়ে গেল। কটু কণ্ঠে বললে, অন্যায় বলেছি। দু’চোখ বড় বড় করে দেখুন, আপনাকে আমি লজ্জা করব না। স্নানের সময় গােরু মহিষও তাে মাঠে মাঝে মাঝে জল খেতে আসে!
ঘুরে দাঁড়িয়ে পা বাড়াল। পেছনে ব্যাকুল কণ্ঠ শােনা গেল, দাঁড়ান। মেয়েটি ফিরে দাঁড়াল।
আমায় বিশ্বাস করুন, আপনি স্নান করছিলেন আমি তা দেখিনি। আর একদিনের কথা বললেন, কিন্তু আমি কাল মােটে কলকাতা থেকে এখানে এসেছি। আশেপাশে যদি দু-একটা পাখি মেলে এই আশায় সকালে বন্দুকটা নিয়ে বেরিয়েছিলাম। একটা ঘুঘু এই দিকে উড়ে এসেছিল, কোথায় বসল তাই দেখছিলাম, আপনাকে নয়। হাতের বন্দুকটা দেখিয়ে বললে, এটা দেখে আপনার বিশ্বাস হওয়া উচিত। পিছন ফিরে ঘাটের দিকে চলতে চলতে মেয়েটি বললে, ন্যাকামি করবেন না, আমি কচি খুকি নই।

ছেলেটির মুখ কালাে হয়ে গেল। সকাল বেলার উজ্বল আলাে পর্যন্ত যেন এক সুন্দরী তরুণীর দেওয়া কুৎসিত অপবাদের ছাপে মলিন হয়ে উঠল। ছেলেটি নিশ্বাস ফেলে সরে গেল। পলাতক ঘুঘুটা চোখের সামনে দিয়ে উড়ে গিয়ে কাছেই একটা ডালে বসল, বন্দুক তুলতে ইচ্ছা হল না। আঁকা-বাঁকা সরু পথটি ধরে বাগান পার হয়ে খিড়কির দরজা দিয়ে সাদা বাড়িটায় ঢুকল। বন্দুকটা বড় ঘরের কোণে ঠেস দিয়ে রেখে বিরস মুখে খাটের একধারে বসে পড়ল।
মা বললেন, কি শিকার করলি রে অশােক?
অপবাদ।
অপবাদ ?
ই, বলে খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে অশােক বললে, গাঁয়ের মেয়েগুলাে ভারি ঝগড়াটে হয়, না মা?
কারু সঙ্গে ঝগড়া করে এলি নাকি?

অশােক বললে, আমায় করতে হয়নি একাই করেছে। বাবু স্নান করছিলেন, ঘুঘু খুঁজতে যেই পুকুর পাড়ে গেছি, জল থেকে উঠে এসে যা মুখে এল শুনিয়ে দিল। “ওঁৎ পেতে ছিল বােধহয়! বাপ, থাকো তােমরা এখানে, কাল আমি কলকাতা চম্পট দিচ্ছি। মা বললেন, কোন পুকুর? বাগানের ভিতরটা?
অশােক ঘাড় নেড়ে সায় দিল।
তবে বােধহয় হৃদয় মােক্তারের ভাগ্নী। খুব সুন্দর দেখলি?
দেখলাম? না দেখতেই যা শােনাল, দেখলে বােধহয় খেয়েই ফেলত। অশােকের কুদ্ধ মুখের দিকে চেয়ে মা হেসে ফেললেন, না রে, খুব ভালাে মেয়ে, দোষের মধ্যে একটু তেজী আর ঠোট কাটা।
অশােক বললে, হুঁ!

মা বললেন, মেয়েদের একটু তেজ থাকা ভালাে রে, কাজ দেয়। অন্যায় ও মােটে সহ্য করতে পারে না।
অশােক বললে, জানি। খুব ন্যায়বান ও! কাল এলাম আমি এই জঙ্গলে, আর বলে কিনা আরেকদিন উঁকি মারছিলেন!


চিনতে পারেনি। নেকী তাে প্রায়ই আসে আমার কাছে, চিনলেই দেখিস ক্ষমা চেয়ে নেবে।
নেকী? ওর নাম নেকী নাকি?
হ্যা, ছেলেবেলায় নাকে কাঁদত বলে ওর পিসি ওই নাম রেখেছিল। মা হেসে ফেললেন। অশােক বললে, নাকে কাদত? যেরকম বলছিল মা, আমি আর একটু হলে কেঁদে ফেলতাম।




আজও যে সন্ধ্যার পর কালবৈশাখী দেখা দেবে দুপুর বেলার প্রচণ্ড গুমােট সে সত্যটা নিঃসংশয়েই জানিয়ে দিচ্ছিল। কাল বৃষ্টি হয়ে গেছে, আজ ভ্যাপসা গরমে যেন সিদ্ধ করে দিচ্ছে। শুকনাে খটখটে গরম বরং সহ্য হয়, এই ভিজে গরম এমন উৎকট লাগে। বিছানায় শীতল পাটি বিছিয়েও অত্যধিক উত্তপ্ত হয়ে অশােক ঘামছিল। মা বাড়ি নেই, কাছেই এক মুন্সেফের বাড়ি বেড়াতে গেছেন। রােদ বৃষ্টিতে আর যা কিছু আটকাক মেয়েদের বেড়ানােটা আটকায় না। ছােট ভাই পুলকের সকালে স্কুল, আমবাগানে তার খোঁজ মিলতে পারে।

হাতের বইটা টেবিল লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিয়ে অশােক উঠে বসল। ভিজে তােয়ালে দিয়ে সর্বাঙ্গের ঘাম মুছে অধোমুক্ত বাতায়ন পথে বাইরে গুমােট পৃথিবীর ওপর সূর্যালােকের নিষ্ঠুর অত্যাচারের দিকে চেয়ে রইল। দুপুর বেলা, কিন্তু চারিদিকে গভীর রজনীর স্তব্ধতা ব্যাপ্ত হয়ে আছে। প্রকৃতির অস্বাভাবিক গাম্ভীর্য যেন স্পর্শ করা যায়, অনুভূতির সীমার মাঝে যেন আপনি হাত বাড়িয়ে ধরা দিতে চায়। রাত দুপুরে যা নিজস্ব আজ দিন দুপুরে চমৎকার মানিয়ে গেছে। হঠাৎ চাপা দীর্ঘশ্বাসের মতাে সামান্য একটু বাতাস বয়ে যেতেই ভেজানাে দরজাটা মৃদু শব্দ করে খুলে গেল। মুখ ফিরিয়ে চাইতেই অশােক অবাক হয়ে দেখল খান দুই বই হাতে করে নেকী উঠান দিয়ে আসছে। ভিজে চুল পিঠের ওপর ছড়িয়ে রয়েছে, রােদের হাত থেকে বাঁচার জন্য শাড়ির আঁচলটুকু মাথায় তুলে দিয়েছে। বড় ঘরে উঁকি মেরে অশােকের মাকে না দেখে মাসিমা বলে ডাক দিয়ে নেকী অশােকের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। বিছানার উপরের লােকটির দিকে নজর পড়তেই সে রীতিমত চমকে উঠল।

আপনি! ও হা। ঠিক।
অশােক গম্ভীরভাবে বললে, বাড়ি নেই।
বাড়ি নেই? বই দুখানা ফেরত দিতে এসেছিলাম।
জানালা দিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি রেখে অশােক বললে, ও ঘরের টেবিলের ওপর রেখে যান।
নেকীর যাবার লক্ষণ দেখা গেল না। সেইখানে দাঁড়িয়ে সপ্রতিভভাবে প্রশ্ন করলে, আপনি অশােকবাবু না?
তাহলে কালকের ঘুঘুর কথাটা বিশ্বাস করতে হল।
নেকীর মুখের দিকে চেয়ে অশােক বলল, আমার সৌভাগ্য। বিশ্বাসটা হল কিসে?
আমি অশােকবাবু বলে?
মৃদু হেসে নেকী বললে, হ্যা। মাসীমার কাছে আপনার কথা এত শুনেছি যে, বিশ্বাস। করে উপায় নেই। আপনার আসবার কথা জানতাম, রাগের মাথায় খেয়াল ছিল না। এখানকার কোনাে ফাজিল ছোকরা মনে করেছিলাম আপনাকে। বেশ করেছিলেন।

আপনি ভীষণ চটেছেন দেখছি।
অশােক কথা বললে না।
নেকী বলল, চটার কথাই। মিথ্যে অপবাদ কে আর সইতে পারে? আচ্ছা, আমি হাত জোড় করে ক্ষমা চাচ্ছি, তাতে হবে তাে?
হবে। কেউ বাড়ি নেই, বিকেলে এলে ভালাে করতেন।
অর্থাৎ, আপনি এখন যান, এই তাে?
অশােক নির্বিকার উদাসীন কণ্ঠে বললে, সেই রকম মানেই তাে দাঁড়ায়। নেকীর মুখ ম্লান হয়ে গেল, কথা না খুঁজে পেয়ে বলল, তাড়িয়ে দিচ্ছেন?
না, না, তাড়াব কেন? অতখানি অভদ্রতা করতে পারি আপনার সঙ্গে? আমার বলবার উদ্দেশ্য- অশােক থেমে গেল।
উদ্দেশ্য?
উদ্দেশ্য মরুক। আসল কথা কি জানেন, আপনাকে আমি ভয় করি। হয়তাে বলে বসবেন, একলা পেয়ে আপনাকে আমি অপমান করেছি।
বাকিও তাে রাখলেন না কিছু।
এ অপমান নয়, অন্য রকম।




অভদ্র উক্তি কুৎসিত ইঙ্গিত। চারিদিকের নির্জনতা অন্য রকম অপমানের অর্থটাকে এমনি স্ফুটতর করে তুলল যে, অপমানে নেকীর মুখ লাল হয়ে উঠল। বই দুটি মেঝের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বললে, আপনি চাষা। নিজের মনে ময়লা থাকলে সমস্ত পৃথিবীটাকে কালাে দেখায়। স্নানের ঘাটেই পরিচয় পেয়েছি। বলে ঝড়ের মতাে চলে গেল। মিথ্যা অপবাদের জ্বালা আছে, তাতে রাগ হওয়াটাও আশ্চর্য নয়। কিন্তু এইবার অশােক স্পষ্ট উপলব্ধি করল, সে ভুল করেছে। শ্রদ্ধা যার প্রাপ্য তাকে দিয়েছে অপমান।

সে না হয় নজর দিতে যায়নি, কিন্তু অমন কি কেউ যায় না? বাঙ্গালির মেয়ে, লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে গিয়ে কোনাে রকমে ক্ষুধিত দৃষ্টির সম্মুখ থেকে নিজের দেহটা সরিয়ে নিয়ে যায়। অমন মুখােমুখি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে ক’টি মেয়ে? ঘৃণায় নাসিকা কুঞ্চিত করে কটি মেয়ে, একান্ত নির্জনে একজন অপরিচিত যুবকের ওপর বলতে পারে, আপনি গােরু, আপনাকে আমি লজ্জা করব না। আজ তুচ্ছ আত্মাভিমানের বশে সেই মেয়েটিকেই সে অপমান করেছে। তাও সে যখন ক্ষমা চেয়েছে তখন। বিকালে দু-ভাইকে খাবার দিয়ে মা বললেন, তাের নেকীদি দু-দিন এল না কেন রে পুলক?

পুলক আমে কামড় দিয়েছিল, আমটা সরিয়ে সংক্ষেপে জবাব দিল, দাদা বকেছে। বলে আবার আমটা মুখে তুলল।
হুঁ।
আবার ঝগড়া হয়েছে তােদের? কি হয়েছিল?
অশােক বললে, পরশু তুমি বাড়ি ছিলে না, দুপুর বেলা বই হাতে করে এসে হাজির। যেমনি বলেছি মা বাড়ি নেই, বিকেলে আসবেন, যা মুখে এল বলে চলে গেল। সবটুকু দোষ অশােক নির্বিবাদে নেকীর ঘাড়ে চাপিয়ে দিল। এমনি করে মানুষ নিজের অন্যায় করার জ্বালার সান্ত্বনা খোঁজে! বেদনা দেওয়া সহজ, আঘাত করা ততােধিক। কিন্তু অমন একটা সহজ কাজ করেও সুখ মেলে না। সুন্দরী এবং তরুণী, তার হাসিভরা মুখখানি যে কথার আঘাতে ম্লান করে দিয়েছিল, এই স্মৃতিটা কাটার মতাে ক্রমাগত বিধে চলে।

মা বললেন, কি ছেলেমানুষি যে তােরা করিস অশােক। নেকী তাে গায়ে পড়ে ঝগড়া করার মেয়ে নয়।
না। খুব ভালাে মেয়ে!
রােদ পড়ে এলে পুলককে নিয়ে অশােক বেড়াতে বের হল। আমবাগানের পরেই বিস্তৃত মাঠ, আলে আলে পায়ে পায়ে গড়ে ওঠা সরু পথটি দিয়ে চলতে তার এমনি ভালাে লাগে! মাঝে মাঝে লাঙল দেওয়া ক্ষেতে নেমে পড়ে, মাটির ঢেলাগুলি পায়ের নীচে গুড়িয়ে যায়। ক্ষেতগুলি সমস্ত দিন বৈশাখের বেহিসাবী সূর্যের তাপ চুরি করে সঞ্চিত করে রাখে, সূর্য বিদায় নিলে মৃদুভাবে সেই তাপ বিকীর্ণ করে। অশােক সর্বাঙ্গ দিয়ে সেইটুকু অনুভব করে। চষা মাটির অস্পষ্ট সুবাস তার মনকে উদাস করে দেয়। পুলকের হাত ধরে চলতে চলতে অশােক ভাবে, এমনি ভাবেই মাটি যেন নিজেকে চিনিয়ে দিতে চায়। নিশ্চল জড় যেন বলতে চায়, সারা জগতের জীবনের রস যােগাই আমি, আমায় চিনে রাখাে।




মাঠের পরে বাড়ি থেকে মাইল খানেক তফাতে ছােট একটা নদী, এখন স্রোত নেই। স্থানে স্থানে জল জমে আছে, বাকিটুকু বালিতে বােঝাই। সাদা ধবধবে বালি। এককালে স্রোতের নিচে ছিল, জলের গতি নিপুণ শিল্পীর মতাে অপূর্ব নক্সা এঁকে দিয়েছে। কোথাও বালির বুকের ঢেউয়ের ছবির হুবহু ছাপ পড়েছে, কোথাও বিচিত্র রেখার সমাবেশে সূক্ষ্ম আলপনা গড়ে উঠেছে। এমনি সূক্ষ্ম এমনি কোমল যে, দেখলে মনে হয় আঁকল কে? অশোক নিত্য এইখানে এসে বসে। পায়ের দাগে বালির কারুকার্য নষ্ট হয়ে যায়, অশােক ব্যথিত হয়ে ওঠে। অথচ এই কারুকার্য শতকরা নিরানব্বই জনের চোখেই পড়ে না। তুচ্ছ বলে নয়, সূক্ষ্ম সৌন্দর্য আবিষ্কার করবার মানুষের একটা বিপুল অক্ষমতা আছে বলে।

অশােক আজ সেখানেই যাচ্ছিল। আম বাগানের ভেতরে একটা মােটা গাছের গুঁড়ি পাক দিতেই অশােক আর নেকী একে বারে মুখােমুখি পড়ে গেল। কাপড় গামছা নিয়ে নেকী স্নান করতে যাচ্ছিল, চোখাচোখি হতেই তার মুখের ভাব কঠিন হয়ে উঠল। নিঃশব্দে একপাশে সরে গিয়ে সে অশােককে পথ দিল।
অশােক এগিয়ে গেল, কিন্তু পুলক নেকীর সামনে দাঁড়িয়ে বললে, আর যে আমাদের বাড়ি যাও না নেকীদি? দাদা আর কিছু বলবে না, মা বকে দিয়েছে। অশােক এগিয়ে গিয়েছিল, দাঁড়িয়ে ডাকল, পুলক আয়, দেরী হয়ে গেছে। নেকী পুলককে কাছে টেনে নিয়ে কি বলতেই সে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। নেকীর হাত থেকে গামছাটা টেনে নিয়ে বললে, তুমি যাও দাদা, আমি যাব না। নেকীদির সঙ্গে সাঁতার কাটব।
বেড়াতে যাবি না?

পুলক ঘাড় নেড়ে বলল, রােজ তাে বেড়াই, আজ সাঁতার দেব। তুমিও এস না দাদা, তিনজনে সুইমিং রেস দেব, নেকীদির সঙ্গে পারবে না তুমি। অশােক ধমক দিয়ে বললে, এই অবেলায় পচা ডােবায় স্নান করলে অসুখ হবে পুলক। এখন বেড়িয়ে আসি, কাল সকালে বড় পুকুরে সাঁতার কাটব। পুকুরের ছােট-বড়ত্বের জন্য পুলকের মাথাব্যথা ছিল না, নেকীদির সঙ্গে সাঁতার দিতে পেলেই সে সুখী। নেকীর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তার একটা হাত ধরে দাদার প্রস্তাবে প্রবল আপত্তি জানিয়ে দিল। নেকী তার হাত ধরে পুকুরের দিকে অগ্রসর হল। অশােক ক্রুদ্ধ হয়ে বললে, এই অবেলায় ওকে যে পচা ডােবায় স্নান করবার জন্য নাচালেন, অসুখ হলে দায়ী হবে কে?

আরও পড়ুনঃ গল্পঃ লজ্জাহর 

মুখ না ফিরিয়ে নেকী জবাব দিল, আমি। ওর অভ্যাস আছে।
অভ্যাস আছে কি রকম? ও কি গেঁয়াে ভূত, যে পচা ডােবায় স্নান করা অভ্যাস থাকবে?
গেঁয়াে ভূত না হােক, শহুরে বাবু নয়। বলে নেকী পুলককে নিয়ে মােটা আমগাছটার ওদিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
শহুরে বাবু! মেয়েটা শেষ পর্যন্ত তাকে শহুরে বাবু ঠাওরালাে নাকি। নিতান্ত চটে যত দূর সম্ভব দূরে দূরে পা ফেলে হন হন করে বাগান পার হয়ে অশােক মাঠে পড়ল। মাঠে বেড়ানাের আনন্দটুকু মাঠে মারা গেল। অশােক ভাবলে, কী কুক্ষণেই মেয়েটার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।




সন্ধ্যার অন্ধকার একটু অস্বাভাবিক রকম ঘন হয়ে এল। সেদিকে অশােকের নজর পড়ল না। নজর পড়লে নদীর চড়ায় বসে থাকার মতাে সাহস তার হত না। ঈশান-কোণের জমাট-বাঁধা কালাে ছায়াটি যে রকম দ্রুতবেগে আকাশের অর্ধেকটা ঢেকে ফেললে তাতে আর অল্পক্ষণের ভেতরেই যে সমস্ত আকাশ ঢেকে ফেলবে সে। বিষয়ে সন্দেহ করার উপায় রইল না। হলও তাই। আকাশ যখন প্রায় সবই ঢাকা পড়েছে। তখন অশােক হঠাৎ ব্যাপারটা উপলব্ধি করল। তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়িয়ে দিল। যতবার শঙ্কিত দৃষ্টি তুলে আকাশের ভয়ানক কালাে গম্ভীর মূর্তির দিকে চাইল ততবারই তার গতিবেগ বেড়ে গেল। নেকী তাে নেকী, ঝড় শুরু হবার আগে কোনাে রকমে বাড়ি পৌঁছানাের চিন্তা ছাড়া অন্য সব কথা তার মন থেকে বেমালুম লুপ্ত হয়ে গেল। এসময় এরকম নিত্যকার ব্যাপার হলেও ইতিপূর্বে পূর্ববঙ্গের কালবৈশাখীর যে পরিচয় পেয়েছিল তাতে এই নির্জন মাঠে সেই কালবৈশাখীর সঙ্গে মুখােমুখি দাঁড়াবার কল্পনা করেই সে ভয় পেয়ে গেল।

জমাট-বাঁধা অন্ধকারকে শিউরে দিয়ে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। অশােকের দ্রুত চলা দৌড়নােতে পরিবর্তিত হয়ে গেল।
অশােক পুরী গিয়েছিল, দূর থেকে সমুদ্র গর্জন কেমন শােনায় জানত। পিছন থেকে সেই রকম একটা অস্পষ্ট গর্জন কানে আসতেই সে বুঝতে পারল কালবৈশাখী তাড়া করে আসছে এবং তাকে ধরে ফেলতে মাত্র দু-তিন মিনিটের রাস্তা। হাঁফ ধরে গিয়েছিল দৌড়ে বিশেষ লাভ নেই বরং উঁচু-নীচু মাঠের ভেতর অন্ধকারে আছাড় খাওয়ার আশঙ্কা পুরাে মাত্রায়। বাধ্য হয়ে দৌড়ানাে বন্ধ করে অশােক দ্রুত চলা শুরু করল। আর একবার বিদ্যুৎ চমকাতে অশােক দেখলে আমবাগান তখনাে পাঁচ-সাত মিনিটের পথ।

আমবাগান? ঝড় তাে ধরে ফেলবে ঠিক, তখন আমবাগানের ভেতর দিয়ে যাওয়াটা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে। অশােকের ইচ্ছা হলাে একবার থমকে দাঁড়িয়ে কথাটা ভালাে করে চিন্তা করে নেয়। কিন্তু পিছনের গর্জনটা খুব কাছে এবং বেশিরকম স্পষ্ট হয়ে উঠেছে দেখে দাঁড়াবার সাহস হল না। আর দ্বিতীয় পথের সন্ধান তাে সে রাখে না। অন্য সময় ঘণ্টাখানেক খুঁজে অন্য দিক দিয়ে ঘুরে যাবার ভালাে রাস্তা আবিষ্কার করা হয়তাে সম্ভব হতাে, কিন্তু এখন সারা রাত ধরে খুঁজলেও যে সে পথের সন্ধান মিলবে না তা ঠিক। আমবাগান ছাড়া পথ নেই। কাঁচা পাকা ঢের ফল গাছগুলি খাইয়েছে, আজ যদি নিতান্তই চাপা দেয় কি আর করা যাবে!

পিছন থেকে মহা কলরব করতে করতে ঝড় এসে অশােককে এমনি জোরে ধাক্কা দিল যে, মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তে কোনাে রকম সামলে নিল। আর জোরে চলবার চেষ্টা করবার প্রয়ােজন হল না, বাতাসই অশােককে ঠেলে নিয়ে চলল। ঠিক যেন ভােজবাজি শুরু হয়ে গেল। চিরকাল মাথা উঁচু করেই আছে, কিন্তু গাছগুলি পর্যন্ত সটান শুয়ে পড়বার জন্য আকুলি-বিকুলি শুরু করে দিল। লাখখানেক ঢাক ঢােল বাজিয়ে প্রকৃতি যেন বিদঘুটে রকমের ওয়ার-ডান্স আরম্ভ করে দিল, সব ভেঙে চুরমার করে ঠাণ্ডা হবে। মেঘের সংযম রইল না, ফোটা ছেড়ে ধারাপাত আরম্ভ হয়ে গেল। 

সেই পতনশীল বারিধারা নিয়ে পাগলা হাওয়া এমনি খেলা শুরু করে দিল যে, দেহের অনাবৃত অংশের স্পর্শেন্দ্রিয় দিয়ে এবং বিদ্যুতের আলােতে দর্শনেন্দ্রিয় দিয়ে ভালাে করে অনুভব করে অশােকের ইচ্ছা হতে লাগল সেই মাঠের ভেতরই মুখ গুজে শুয়ে পড়ে। ঝড়ের শব্দ তাে আছেই, তার ওপর আকাশে মেঘেদের অজস্র চমকি ঠুকে আলাে জ্বালাবার অবিশ্রাম চেষ্টার ক্রমাগত যে আওয়াজ হতে লাগল তাতে অশােকের শ্রবণেন্দ্রিয় সংজ্ঞা হারা হয়ে পড়বার উপক্রম করল। আম বাগানের শেষ প্রান্তে হৃদয় মােক্তারের বাড়ি, অশােকের পথ তার রান্নাঘরের পাশ দিয়ে। চাচের বেড়ার গায়ে বসানাে জানালার পাশে আসতেই তীক্ষ কণ্ঠ শােনা গেল, অশােকবাবু, দাঁড়ান। অশােক থমকে দাঁড়াল।




নেকী অশােকের প্রতীক্ষাতেই রান্নাঘরের জানালায় চোখ রেখে দাঁড়িয়েছিল, ডাক দিয়েই বাইরে বেরিয়ে অশােকের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, গলা চিড়ে ডেকেছি, যে শব্দ। ভাবলাম বুঝি শুনতেই পাবেন না। ঘরে চলুন।
না। মা ভাববেন।
অশােকের পথ আগলে দাঁড়িয়ে নেকী বলল, বাগানের ভেতর দিয়ে তাে যাওয়া যাবে না, এর ভেতরেই তিন-চারটে গাছ পড়ে গেছে শব্দ শুনেছি। দাঁড়াবেন না আসুন। অশােক তবু দ্বিধা করল, কিন্তু মা যে পাগল হয়ে উঠবেন। নেকী ব্যাকুল হয়ে বলল, সে অল্পক্ষণের জন্য, কিন্তু যদি গাছ চাপা পড়েন সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাবেন। বলে হাত জোড় করে বলল, অন্য সময় যত পারেন রাগ করবেন, আপনার পায়ে পড়ি চলুন।

আকাশে বিদ্যুৎ চমকে গেল, সেই আলােতে নেকীর মুখের যে ব্যাকুল ভাবটা অশােকের চোখে পড়ল তাতে আর দ্বিধা করবার অবকাশ রইল না। বললে, চলুন। নেকী অশােককে পথ দিখিয়ে রান্না ঘরের পাশ দিয়ে উঠান পার হয়ে বড় ঘরের দাওয়ায় উঠল।
দরজায় বাইরে থেকে শিকল লাগানাে ছিল, ক্ষিপ্র হস্তে শিকল খুলে ফেললে। ঘরে প্রদীপ জ্বলছিল, দরজা খুলতেই বাতাসে নিভে গেল।
অশােককে হাত ধরে ঘরের ভেতর নিয়ে গিয়ে নেকী বললে, দাঁড়ান, আলাে জ্বালছি। ঘরের একদিকে তাক হাতড়ে একটা ল্যাম্প নিয়ে এসে বললে, আপনার কাছে দেশলাই আছে?
না।
সিগারেট খান না?
না।

খুব ভালাে ছেলে তাে! নাঃ, আপনার সঙ্গে তাহলে পারা গেল না দেখচি। রান্না ঘরেই যেতে হল, থাকুন অন্ধকারে চুপটি করে দাঁড়িয়ে। বলে নেকী বাইরে চলে গেল। দেশলাই নিয়ে ফিরে এসে চৌকাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে বললে, হাত বাড়িয়ে দেশলাই নিয়ে আলােটা জ্বেলে ফেলুন অশােকবাবু। একবার তাে দুজনেই খানিকটা করে জল ঢেলেছি, সর্বাঙ্গে যে রকম ধারা বইছে, এবারে ঘরে ঢুকলে মেঝেতে নদী বয়ে যাবে। নিকষ-কালাে আঁধার, কিন্তু তারই ভেতর নেকীর হাতের দুগাছি সােনার চুড়ি রান্নাঘরের অদৃশ্যপ্ৰায় আলােয় চিক চিক করছিল! দেশলাই নিয়ে অশােক একটা কাঠি জ্বালিয়ে বললে, একেবারে ভিজে গেছেন যে!

সেটা উভয়ত, পরে দুঃখ করা যাবে, বাতিটা জালুন।
আলাে জ্বেলে অশােক বলল, মেঝেটা সত্যিই ভেসেছে।
তা হােক, মুছে নিলেই হবে। আলনা থেকে লাল পেড়ে শাড়িটা দিন। বাক্স না খুললে আপনার কাপড় জুটবে না।
অশােক শাড়িটা এনে দিল। বারান্দার একদিকে একটু ঘেরা ছিল, শাড়িটা নিয়ে নেকী সেখানে চলে গেল।

অশােকের জামা-কাপড়ের অতিরিক্ত জলটুকু ইতিমধ্যে প্রায় সবটাই ঝরে গিয়েছিল, কিন্তু ভিজে জামার আলিঙ্গনটা বড়ই বিশ্রী লাগছিল। জামাটা খুলে হাতে নিয়ে নেকীর প্রতীক্ষায় ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অশােক একবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিল। প্রকাণ্ড ঘর। একপাশে দুটি বড় বড় খাট জোড়া লাগিয়ে পাতা রয়েছে। তাতে যে বিছানা আছে খাটের অর্ধেকটাও আবৃত করার সাধ্য তার নেই। সেকেলে আসবাব, যেমন বিরাট তেমনি কদাকার। এক কোণে গােটা কুড়ি পঁচিশ হাঁড়ি, কলসী, তাতে সংসারের চাল ডাল থাকে বােঝা গেল। 

পুরনাে রঙচটা একটা কাঠের আলনা, সােজা দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই, হেলে পড়েছে, ফর্সা, মলিন, আস্ত এবং ছেড়া নানা রকমের নতুন পুরাতন ধুতি শাড়ি সেমিজ যত্ন করে গােছানাে রয়েছে। চাচের বেড়ার গায়ে বাঁশের পেরেকে একটা আয়না ঝুলছে কাছেই একটা চিরুনি গোঁজা। আয়নার নীচে একটা টুল, তার কাছে হাতল ভাঙ্গা কাঠের চেয়ার। একটা আমকাঠের সিন্দুক একটা কোণের সবকিছু দখল করে আছে। মাথা নিচু করে অশােক খাটের নীচে উঁকি মারল। ধুলােয় মলিন বড় বড় পিতলের হাঁড়ি কলসী ডেকচি ইত্যাদি থেকে আরম্ভ করে কুলাে ধুনুচি সেখানে জমা হয়ে আছে।
সােজা হয়ে দাঁড়াতেই দরজার কাছে নেকী খিল খিল করে হেসে উঠে বলে, ভূত দেখছিলেন নাকি?
না বাঘ। অন্ততঃ একটা শেয়াল যে খাটের নীচে




চোখ তুলে অর্ধপথে সে থেমে গেল। মন থেকে রাগের জ্বালা নিঃশেষে মুছে গিয়েছিল, বিদ্বেষ শূন্য দৃষ্টি তুলে লণ্ঠনের আলােতে সম্মুখের তরুণী নারীটির মুখের দিকে তাকিয়ে অশােক মুগ্ধ হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি কাপড় ছেড়ে এসেছে, ভিজে চুল ভালাে করে মােছা হয়নি। এক গােছ জলসিক্ত কুন্তল গালের পাশ দিয়ে লতিয়ে নেমে এসে বুকের ওপর লুটিয়ে পড়েছে। কপালে বিন্দু বিন্দু জল জমে আছে, আলাে পড়ে মনে হচ্ছে কে যেন মেয়েটার কপাল বেড়ে মুক্তোর মালা পরিয়ে দিয়েছে। চোখের পাতা ভেজা, তার অন্তরাল হতে যে দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে তার যেন তুলনা নেই। নেকী লাল হয়ে চোখ নত করলে। হঠাৎ- আচ্ছা তাে আমি! ভিজে কাপড়ে দাঁড়িয়ে আছেন খেয়ালই নেই। বলে কাঠের সিন্দুকটার কাছে চলে গেল। ধােপ-দোরস্ত একখানা ধুতি এনে অশােকের হাতে দিয়ে ভিজে জামাটা নিয়ে বললে, কাপড় ছেড়ে ফেলুন, আমি আসছি। বলে বেরিয়ে গেল।


কাপড় ছেড়ে অশােক ডাকল, আসুন এবার।
নেকী এল। দরজা দিয়ে প্রথম থেকেই কিছু কিছু ছাট আসছিল, ঘরে এসে এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে নেকী দরজায় খিল লাগিয়ে দিলে। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, আমাকে আপনি। আপনি করছেন এমন বিশ্রী লাগছে। এতটুকু সাহস নেই যে তুমি বলেন?
অশােক বলল, সাহস আছে কিনা পরিচয় পাবে। ওটা কি হল? বলে রুদ্ধ দরজার দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিল।
নেকী বলল, এই সহজ কথাটা বুঝলেন না? ছাট আসছিল, বন্ধ করে দিলাম। মেঝেটা ভাসিয়ে দিয়ে তাে লাভ নেই কিছু।
কিন্তু

সে সব পরে বিবেচনা করা যাবে অশােকবাবু, আপনি কেঁচার খুটটা গায়ে দিয়ে ভাঙ্গা চেয়ারটাতে বসুন। আমার নাম নেকী, কিন্তু ন্যাকামি দু’চক্ষে দেখতে পারি না। আপনার সঙ্গে একা এক ঘরে থাকতে পারি, দরজা খােলা বন্ধয় বিশেষ কিছু আসবে যাবে না । খােলা থাকলে বরং ঘরটা ভিজবে।
অশােক বসে বললে, কিন্তু তুমিও বসাে। কতগুলি প্রশ্ন আছে। খাটের কোণায় বসে হাসিমুখে নেকী বলল, হুকুম করুন।
তুমি এখানে একা থাক?
নেকী হেসে উঠল,তাই কি আপনি সম্ভব মনে করেন নাকি?

হাসি থামিয়ে বলল, থাকি তিনজনে, মামা, পিসীমা আর স্বয়ং। মামা জমি দেখতে পরশুদিন মফস্বলে গেছেন, পিসী বিকালে কাদের বাড়ি গিয়েছেন ঝড়ের জন্য আটকা পড়ে গেছে। যে আচমকা ঝড় এল আজ! আপনি ফিরছেন না দেখে আমার যা-ঝড়ের সময় মাঠের মাঝে ভারি ভয় হয় অশােকবাবু।
ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে অশােক বললে, আমি চললাম।
নেকী বিস্মিত হয়ে বললে, কি হল আবার?
আমার মতাে মূখ আর নেই। ছি ছি, একবারও খেয়াল হল না!
কি হল বলুন না?

বুঝলে না? কেউ যদি হঠাৎ এসে পড়ে সে ভারি বিশ্রী হবে, আমি যাই। নেকী বললে, ভাববেন না, এই ঝড়ে কেউ আসবে না। যাবেনই বা কি করে?
না না তুমি বুঝছ না। তােমার কত বড় ক্ষতি হবে, জান?
নেকী দৃঢ় কণ্ঠে বলল, জানি, বসুন। সে ভয় করলে আপনাকে ডেকে আনতাম না। পাগল হয়েছেন, ভালাে দিনে কেউ আসে না, আর ঝড়-বৃষ্টি মাথায় করে গােয়েন্দাগিরি করতে আসবে।
অশােক বসলে। তােমার কিন্তু বেজায় সাহস। লােক নাই জানুক, আমাকে তাে কি একরকম জানই না, কি বলে ডেকে আনলে?
আপনাকে জানি না কে বললে?

আমি বলছি, এসেছি পাঁচ দিন, দেখা হয়েছে তিনবার, তিনবারই ঝগড়া করেছি। চেনবার সুযােগ পেলে কোথায়? পুকুর পাড়ে বরং
নেকী খিল খিল করে হেসে উঠল। ওটা তার স্বভাব। বললে, পুকুরের ঘটনাটা ভােলেননি দেখছি।
না ভুলিনি। ঠাট্টা নয়, সত্যি বল কি করে চিনলে আমায়?
নেকী বলল, একজনকে চিনতে হলে তার সঙ্গে দু-চার বছর মিশবার দরকার হয় বলে মনে করেন নাকি আপনি? আমার সঙ্গে প্রথম থেকে যে এমন ভাবে ঝগড়া করতে পারে তাকে ভয় করা আমি প্রয়ােজন মনে করি না। বুঝলেন?
অশােক ঘাড় নেড়ে বলল, না।

তবে অন্য রকম করে বলি। আমাদের অনুভূতি বলে একটা জিনিস আছে অশােকবাবু, একবার দেখলেই আমরা মানুষকে চিনতে পারি। আর কি জানেন? মাসীমার ছেলেকে চিনবার দরকার হয় না।
নেকীর কথায় তার মার প্রতি এমনি একটা সহজ শ্রদ্ধা ভাব প্রকাশ পেল যে, অশােক খুশি হয়ে উঠল। একটু চুপ করে থেকে বললে, আচ্ছা নেকী, তােমার ভালাে নামটা কি বল তাে?

নেকী নামটা পছন্দ হয় না? ও নামটা আমায় একেবারে মানায় না, কি বলেন?
আপনি না হয় আমাকে লীলা বলবেন?
লীলা? বেশ নাম।
সত্যি! বেশ?
অশােক জবাব দিল না, একটু হাসল।
হঠাৎ নেকী বললে, আপনার খিদে পেয়েছে? আম খাবেন?
অশােক ঘাড় নাড়ল।
আম খাবেন না? তাহলে কী দিই! কাল সন্দেশ করেছিলাম, গােটা চারেক আছে। বােধহয়, তাই খান তবে।

অশােক আবার ঘাড় নাড়ল।
ঘাড় নাড়ছেন যে খালি? ইচ্ছেটা কি?
ইচ্ছে কিছু না খাওয়া। বাড়ি থেকে যতদূর সাধ্য খেয়ে বার হয়েছিলাম, খিদে নেই।
নেকী মুখ গোঁজ করে বলল, হুঁ!
রাগ হল? আচ্ছা। খাব।
থাক, খিদে না থাকলে খেতে নেই।
অশােক তৎক্ষণাৎ বলল, খিদে যেন পাচ্ছে পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, এতক্ষণ বুঝতে পারিনি। কি দেবে দাও, খেয়ে নি।
নেকী হাসি মুখে খাবার নিয়ে এল। শুধু সন্দেশ নয়, আমও কেটে দিল। ঘরেই ছিল। কোণের কলসী থেকে জল গড়িয়ে দিল।

অশােক নিঃশব্দে আহারে মন দিল।
নেকী বললে, খেতে খেতে কথা বলুন, চুপ করে থাকতে ভালাে লাগে না। -কি বলব?
যা খুশি।
যা খুশি নয়, অশােক নেকীর কথাই পাড়ল। একটু একটু করে নেকীর জীবনের যে ইতিহাস সে শুনল তাতে অবাক হয়ে গেল।

গল্পের পরবর্তী অংশ দ্বিতীয় পর্বে – নেকী ২


@👉 Bangla Romantic Love Stories গল্পটি পড়ে যদি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই শেয়ার এবং কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না…..
WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now

Leave a Comment